ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে সোমবার দুপুরে দেখা গেল এক অস্বাভাবিক দৃশ্য—ভর্তি কক্ষজুড়ে অপেক্ষমাণ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ভিড়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন) সিরাজুল ইসলাম সেখানে বসে ছিলেন তাঁর ছেলে রুবাইয়াত সাদাত সামীকে নিয়ে। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় মাত্র দুই নম্বরের জন্য জিপিএ–৫ না পাওয়ায় তিনি ছয়টি বিষয়ে খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, ফল তৈরির প্রক্রিয়ায় কোথাও কোনো ত্রুটি ঘটেছে।
এমন দৃশ্য শুধু তাঁর নয়—ঢাকা বোর্ডের দপ্তরের করিডোর, সিঁড়ি, এমনকি প্রবেশদ্বার পর্যন্ত ভিড় জমেছে হতাশ শিক্ষার্থী ও উদ্বিগ্ন অভিভাবকে। অনলাইনে আবেদন করে প্রিন্ট কপি হাতে নিয়ে ব্যক্তিগত তদবিরে বোর্ডে এসেছেন অনেকেই।
ভিকারুননিসা নূন কলেজের ছাত্রী তানিশা তন্ময়ের মা আফরোজা বেগম বলেন, “আমার মেয়ে মেধাবী, সব সময় ক্লাসে ভালো করে। অথচ তার চেয়ে দুর্বল দুই সহপাঠী জিপিএ–৫ পেয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
একই হতাশা দেখা যায় ঢাকা কমার্স কলেজের এক পরীক্ষার্থীর কথায়, যিনি ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছেন। “ভালো পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ফলাফল বুঝতে পারছি না। তাই খাতা চ্যালেঞ্জ করেছি” জানান তিনি।
মোহাম্মদপুরের ঢাকা স্টেট কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস এম মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, তাঁর কলেজের মানবিক বিভাগের ‘ফার্স্ট গার্ল’সহ পরপর পাঁচজন শিক্ষার্থী একসঙ্গে ফেল করেছে। “এটা কাকতালীয় নয়, নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে” বলেন তিনি।
পুনর্নিরীক্ষায় ফল পরিবর্তনের হার সীমিত-
প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার পর এমন হাজারো আবেদন জমা পড়ে শিক্ষা বোর্ডে। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ—মূল্যায়নের সময় পরীক্ষকের অবহেলা, গাফিলতি বা নম্বর প্রদানের অসাবধানতার কারণে তারা প্রত্যাশিত ফল পাচ্ছেন না। অনেকে এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নেন।
তবে শিক্ষা বোর্ডগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, বিপুলসংখ্যক আবেদন সত্ত্বেও ফল পরিবর্তনের হার খুবই কম। গত পাঁচ বছরে গড়ে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ শতকরা ৯৭ জন আবেদনকারীই আগের ফল বহাল রেখেছেন।
চলতি বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১১টি বোর্ডে গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। অনুত্তীর্ণ হয়েছেন পাঁচ লাখ আট হাজার ৭০১ শিক্ষার্থী। তবুও খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন এসেছে তুলনামূলক কম—দুই লাখ ২৬ হাজার ৫৬১ শিক্ষার্থী মিলে চার লাখ ২৮ হাজার ৪৫৮ খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেছেন। ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়েই এসেছে সবচেয়ে বেশি আবেদন।
গত বছরের তুলনায় এবার খাতা চ্যালেঞ্জ কমেছে ৭২ হাজার ৮৩৬টি। গত বছর এক লাখ ৯২ হাজার ৪৮০ শিক্ষার্থী পাঁচ লাখেরও বেশি খাতা পুনর্নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এবার শুধু ঢাকা বোর্ডেই ইংরেজি বিষয়ে আবেদন এসেছে ৪৮ হাজার ৩৫৮টি। এরপর রয়েছে আইসিটি (২৭,১৯৯), বাংলা (১৯,৪০২), জীববিজ্ঞান (১৪,৫৬৩), পদার্থবিজ্ঞান (১৩,০৬৫), উচ্চতর গণিত (১২,৪০৬), রসায়ন (৯,১৪৩), হিসাববিজ্ঞান (৪,০১৪), পৌরনীতি ও সুশাসন (২,৬৯৩) এবং ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা (২,২১৫)।
এসএসসিতেও একই চিত্র-
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট ১৫ হাজার ২৪৩ শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে জিপিএ–৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৪৫ জন এবং ফেল থেকে পাস করেছেন প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থী। ঢাকা বোর্ডে ফল পরিবর্তন হয়েছে দুই হাজার ৯৪৬ শিক্ষার্থীর, যার মধ্যে ২৮৬ জন নতুন করে জিপিএ–৫ পেয়েছেন এবং ২৯৩ জন ফেল থেকে পাস করেছেন। এমনকি তিনজন শিক্ষার্থী সরাসরি ফেল থেকে জিপিএ–৫ অর্জন করেছেন।
দাখিল পরীক্ষায় ফল পরিবর্তন হয়েছে ১ হাজার ৯১২ জনের। এর মধ্যে ১৩৯ জন নতুন করে জিপিএ–৫ পেয়েছেন, আর ফেল থেকে পাস করেছেন ৯৯১ জন। কারিগরি বোর্ডে ফল পরিবর্তন হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ জনের, তাদের মধ্যে তিনজন ফেল থেকে সরাসরি জিপিএ–৫ পেয়েছেন।
পুনর্নিরীক্ষা মানেই পুনর্মূল্যায়ন নয়-
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহা. মোকবুল হোসেন বলেন, “এত কম পরিবর্তনের হার মানে এই নয় যে মূল্যায়নের মান বেড়েছে। বরং পুনর্নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতার কারণেই প্রকৃত ভুল ধরা পড়ে না।” তাঁর মতে, পুনর্নিরীক্ষা মানে খাতা নতুন করে দেখা নয়, কেবল যোগ–বিয়োগ বা নম্বর স্থানান্তরে ভুল আছে কিনা তা যাচাই করা।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, “খাতা নতুন করে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু দেখা হয়, সব প্রশ্নের নম্বর দেওয়া হয়েছে কিনা এবং যোগফল সঠিকভাবে হিসাব করা হয়েছে কিনা।”
তিনি আরো বলেন, “কখনো কখনো একজন পরীক্ষার্থী ভালো নম্বর পেলেও হিসাব কষে সঠিক জায়গায় বসাতে ভুল হয়। খাতা দেখেন যাঁরা, তারাও মানুষ। ভুল হলে দায়ী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
শিক্ষাবিদদের মত: অনাস্থা ও পদ্ধতিগত সংকট-
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী খাতা চ্যালেঞ্জে আগ্রহী হওয়াই মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর আস্থাহীনতার প্রকাশ। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন বলেন, শিক্ষকরা পর্যাপ্ত সময় পান না, অনেক সময় খাতা দেখা হয় তাড়াহুড়ায়। এতে সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয় না।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “খাতা পুনর্নিরীক্ষা প্রক্রিয়া এত সীমিত যে প্রকৃত ভুল ধরা পড়ে না। গবেষণাতেও দেখা গেছে, একই উত্তর ভিন্ন পরীক্ষক মূল্যায়ন করলে বড় পার্থক্য দেখা যায়।” তাঁর মতে, মূল্যায়নের প্রশিক্ষণ, সময়সীমা ও পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার ঘাটতি এখনো বড় সমস্যা।
মূল্যায়নে ভুল কেন ঘটে-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, “খাতা মূল্যায়নে ভুল থাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এই ভুলের কারণ খুঁজে দেখা জরুরি। ফল দ্রুত প্রকাশের তাগিদে আমরা অনেক সময় যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারি না।”
তিনি বলেন, “শিক্ষকরা দ্রুত ফল দিতে গিয়ে প্রচুর খাতা দেখতে বাধ্য হন। অনেকে খাতা দেখা বাড়তি আয়ের উৎস মনে করেন, ফলে সময়সীমা কমে যায়, মনোযোগও কমে।”
তাঁর মতে, দেশে এখনো সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন মানদণ্ড বা রুব্রিক নেই। “একজন শিক্ষক কীভাবে কত নম্বর দেবেন, তার নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। ফলে মূল্যায়ন হয়ে পড়ে সাবজেকটিভ। একই শিক্ষক ভিন্ন সময়ে একই খাতা ভিন্নভাবে নম্বর দিতে পারেন।”
ড. মনিনুর রশিদ মনে করেন, “ন্যায্য মূল্যায়নের জন্য একক মানদণ্ড তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।” তিনি যোগ করেন, “যত সামান্য ভুলই হোক, ২–৩ শতাংশ ফল পরিবর্তনও শিক্ষার্থীর জীবনে বড় প্রভাব ফেলে।”
আস্থা পুনরুদ্ধারের দাবি-
বিশ্লেষকদের মতে, খাতা পুনর্নিরীক্ষার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে স্বচ্ছ ও নির্ভুল মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার্থীদের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে। খাতা মূল্যায়নে প্রযুক্তির ব্যবহার, পরীক্ষক প্রশিক্ষণ এবং সময়সীমা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
কারণ একটি ভুল হিসাব বা নম্বর স্থানান্তর, একজন শিক্ষার্থীর এক বছরের পরিশ্রমকে ব্যর্থতায় পরিণত করতে পারে—আর সেই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ, প্রাপ্ত নম্বরের মতোই- আজও অনিশ্চিত রয়ে গেছে।

