গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প আজ ধুঁকে ধুঁকে চলছে। একসময় গ্রামগঞ্জে শীতের সন্ধ্যায় যাত্রাপালার রমরমা আসর বসত, নৃত্য-সংগীত আর নাটকীয় সংলাপ দর্শককে রাতভর মঞ্চের সামনে আটকে রাখত। প্যান্ডেলের চারপাশে বসত চা-বিড়ি, ছোট হোটেল আর স্থানীয় ব্যবসা—যাত্রাপালা ছিল গ্রামের বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র।
কিন্তু আজ সেই রঙিন দৃশ্যের পরিবর্তে আছে করুণ বাস্তবতা। দেশে কোথাও নিয়মিত যাত্রাপালা প্রদর্শনের অনুমতি পাওয়া যায় না। শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মালিক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে যাত্রাশিল্প ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। ফলে এই শিল্পের ভবিষ্যত নিঃসন্দেহে সংকটাপন্ন।
যাত্রাপালা প্রদর্শনের অনুমতি জেলা প্রশাসনের কাছে। কিন্তু নানা জটিলতা আর অনভিপ্রেত বাধার কারণে সম্প্রতি সারা দেশে কোনো আয়োজন হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজন করা কয়েকটি উৎসব ছাড়া অন্য কোথাও নিয়মিত যাত্রাপালা দেখা যায়নি। পেশাদার যাত্রাশিল্পীরা বলছেন, তারা মহড়ার জন্যও প্যান্ডেল পেতে পারছেন না। শুধু নাম শুনলেই স্থানীয় কিছু মানুষ অনুষ্ঠান ভঙ্গ করে দেয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে ডায়মন্ড যাত্রা হাউজ, আনন্দ অপেরা, চৈতালি অপেরা, সোনার বাংলা অপেরা, মহানন্দা অপেরা, সুন্দরবন অপেরা—এই সব দলের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহ্য। কিন্তু অনুমতি না থাকায় তাদের কোনো পারফরম্যান্স হচ্ছে না। সাধারণত দুর্গাপূজা থেকেই যাত্রাপালা মৌসুম শুরু হয়। অথচ শিল্পীরা এখন এক প্যান্ডেলও ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ যাত্রাশিল্পী মালিক সমিতির একাংশের সভাপতি এম আলম লাভলু বলেন, “দেশের যাত্রাশিল্প ও শিল্পীদের অবস্থা খুব করুণ। সরকার আসে যায়, কিন্তু এই শিল্পের কোনো পরিবর্তন হয় না। শিল্পীদের কথা কেউ ভাবে না। অনেক সময় প্রয়োজন হয় পৃষ্ঠপোষকতার, কিন্তু আমরা ঠিক কিভাবে টিকে আছি, তা কেউ দেখছে না।”
শিল্পকলা একাডেমি চেষ্টা করেছে—যাত্রাদলের নিবন্ধন করা হয়েছে, ২০৫টি দল নিবন্ধিত। অশ্লীলতার অভিযোগ আছে এমন কিছু দলও বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে শিল্পীরা বলছেন, এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। তারা চাচ্ছেন, জেলা পর্যায়ে নিয়মিত অনুমতি মিলুক, যেন নিয়মিতভাবে যাত্রাপালা প্রদর্শন সম্ভব হয়।
গবেষক ও শিল্পী মিলন কান্তি দে বলছেন, “যাত্রা প্রদর্শনের জন্য আলাদা মঞ্চ আজও হয়নি। অনুমতি জটিলতার কারণে অনেক দল কার্যত বন্ধ। বিখ্যাত শিল্পীরাও অনেকেই মারা গেছেন বা কঠিন অবস্থায় আছেন। ২০১২ সালে যাত্রাশিল্প নীতিমালা গেজেটভুক্ত হলেও এর সুফল তেমন দেখা যায়নি।”
শিল্পীরা আশা করছেন, বর্তমান সরকার ও জেলা প্রশাসন নিয়মিতভাবে যাত্রাপালা প্রদর্শনের অনুমতি প্রদান করবে। শিল্পকলা একাডেমি উদ্যোগ নিলেও জেলা পর্যায়ে বাধা দূর করা না গেলে যাত্রাশিল্পের জীবনসংকট অব্যাহত থাকবে।
যাত্রাশিল্প শুধু বিনোদন নয়, এটি গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বছরের শেষের দিকে গ্রামের মানুষদের আনন্দ দিত, শিল্পীরাও জীবন নির্বাহ করতেন। আজ সেই ঐতিহ্য ধুঁকে ধুঁকে চলছে। প্রশাসনিক সহায়তা, মঞ্চ ও অনুমতির অভাব দূর না হলে এই শিল্প চিরতরে জাদুঘরের সামগ্রী হয়ে যেতে পারে। গ্রামবাংলার সংস্কৃতি, শিল্পী ও দর্শকের স্বার্থে এখনই প্রয়োজন এক সচেতন উদ্যোগ।