বাংলাদেশে টেলিভিশন ও ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্মের যাত্রালগ্ন থেকেই নির্মাতাদের জন্য এটি নতুন সৃজনশীলতার মঞ্চ। এখানে নেই কোনো সেন্সরশিপের বাধা, ফলে গল্প বলার স্বাধীনতা অনেক বেশি। সাহসী, ভিন্নধর্মী এবং কখনও কখনও চমকপ্রদ গল্প তৈরি করতে পারেন নির্মাতা।
কিন্তু স্বাধীনতার সঙ্গে আসে দ্বন্দ্ব। অনেক সময় গল্পকে জীবন্ত করার চেষ্টায় নির্মাতারা অতিরঞ্জিত দৃশ্য এবং রগরগে সংলাপ ক্যামেরায় তুলে ধরেন। দর্শকের চোখে এসব অশ্লীল মনে হতে পারে। বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের দৃশ্য নিয়ে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ে, সামাজিক মাধ্যমে থেকে শুরু করে গণমাধ্যম পর্যন্ত বিষয়টি আলোচিত হয়। কখনও কখনও নির্মাতারা বা প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন।
যদিও সিনেমার জন্য ‘চলচ্চিত্র সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড’ আছে, অনলাইনের কনটেন্ট তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর ফলে ওয়েব সিরিজ বা ফিল্মে উঠে আসে অশ্লীল সংলাপ, সহিংসতা বা রাজনৈতিক ইঙ্গিত। দর্শকের অভিযোগ, এসব কনটেন্ট পরিবার নিয়ে দেখা যায় না। আবার অনেকে বলছেন, এই স্বাধীনতাই ওটিটির সৌন্দর্য—নইলে এটি টেলিভিশনের নাটক থেকে আলাদা হতো না।
নির্মাতাদের অবস্থাও জটিল। একদিকে তারা মুক্তভাবে গল্প বলতে চান, অন্যদিকে সেন্সরের ভয় তাদের বাধ্য করে গল্পে কাটছাঁট করতে। তাদের মতে, “যদি সেন্সর চালানো হয়, তবে ওয়েব সিরিজ আর টেলিভিশন নাটকের মধ্যে পার্থক্য থাকবে না।”
শুরুতে অনেক ওয়েব কনটেন্ট দর্শক টানার জন্য অশ্লীলতার আশ্রয় নিয়েছিল। ‘বুমেরাং’, ‘সদরঘাটের টাইগার’, ‘আগস্ট ১৪’ প্রভৃতি কনটেন্ট সমালোচনার মুখে পরে বা সংশোধন করা হয়। কিন্তু ‘তাকদীর’, ‘কাইজার’, ‘উনোলৌকিক’ জাতীয় সিরিজগুলো দর্শককে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে, কারণ এসব গল্পে বাস্তব জীবনের অন্ধকার দিক ফুটে উঠেছে।
গত দুই বছরে অশ্লীল সংলাপ ও দৃশ্যের ব্যবহার অনেকটাই কমেছে। কিন্তু সম্প্রতি কুরবানি ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘পাপ কাহিনি’ সিরিজ নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। নির্মাতা শাহরিয়ার নাজিম জয় নিজে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সঙ্গে আছেন রুনা খান, মৌসুমী মৌ, তানজিয়া মিথিলা। সিরিজে এমন কিছু দৃশ্য রয়েছে যা পরিবারের সবাই নিয়ে দেখা যায় না। ছোট ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় প্রশ্ন উঠেছে—ওটিটি কতদিন নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে?
আন্তর্জাতিক নজিরও লক্ষ্যণীয়। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে, কারণ সেখানে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ, নগ্নতা ও যৌন কর্মকাণ্ডের ভিডিও ছিল। এটি দেখিয়ে দেয়, নিয়ন্ত্রণহীন কনটেন্ট কতটা সামাজিক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে সমাধান কি হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে, ওটিটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখা ঝুঁকিপূর্ণ, আবার পুরোপুরি সেন্সর করা সম্ভব নয়। ভারসাম্যই চাবিকাঠি। প্ল্যাটফর্মগুলো নিজ উদ্যোগে বয়সভেদী রেটিং ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করতে পারে, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া যেতে পারে, আর দর্শককেও সচেতন হতে হবে।
ওটিটি সেন্সরশিপ নিয়ে বিতর্ক শেষ হওয়ার নয়। কেউ মনে করেন সেন্সর ছাড়া সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বাড়বে, আবার কেউ বলে সেন্সর মানেই শিল্পের স্বাধীনতা হানি। মূল প্রশ্ন হলো—আমরা কি এমন একটি ভারসাম্য তৈরি করতে পারব যেখানে নির্মাতারা সাহসী গল্প বলবেন, আবার সমাজও সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতার নিরাপত্তা পাবে? ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সূক্ষ্ম সীমারেখা কোথায় টানা যায় তার ওপর।