বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সালমান শাহ শুধু একজন নায়ক নন—তিনি এক যুগের প্রতীক। তাঁর হঠাৎ মৃত্যু যেন এক ঝড়ের মতো নেমে এসেছিল ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে। সেই ঝড়ের রেশ এখনও থামেনি। ২৯ বছর পেরিয়ে গেলেও ভক্তদের মনে রয়ে গেছে একটিই প্রশ্ন—সালমান শাহ কি আত্মহত্যা করেছিলেন, নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল?
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আবারও আদালত নির্দেশ দিয়েছেন মামলার পুনঃতদন্তের। ঢালিউডের কিংবদন্তির মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনের নতুন এই আদেশ যেন আবার আলো জ্বেলে দিয়েছে পুরনো এক অন্ধকারে।
১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। সারাদিন কেটেছিল ‘প্রেম পিয়াসী’ ছবির ডাবিংয়ে—এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে সহ-অভিনেত্রী শাবনূরের সঙ্গে। শুটিং স্পটে হাসি-ঠাট্টা, খুনসুটি—সবই ছিল আগের মতোই প্রাণবন্ত। কিন্তু সাক্ষীরা বলেন, আনন্দের সেই আবরণে যেন লুকিয়ে ছিল একরাশ অস্থিরতা, এক ধরনের অজানা চাপ।
দুপুরের দিকে সালমান শাহ বাবাকে ফোন করে বলেন, সামিরাকে (তার স্ত্রী) যেন এফডিসিতে আনা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামিরা শ্বশুরের সঙ্গে এসে উপস্থিত হন। আর তখনই শুরু হয় উত্তেজনার সূচনা।
সামিরা দেখেন, সালমান ও শাবনূর ডাবিং রুমে হাসি-আড্ডায় মেতে আছেন। তখনকার বিনোদন পত্রিকাগুলোয় দুজনকে নিয়ে নানা গুজব ঘুরছিল, যা সামিরার মনে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয়। মুহূর্তেই তিনি রাগে এফডিসি থেকে বেরিয়ে যান।
সালমানও বিষয়টি বুঝতে পারেন। সামিরাকে থামাতে তিনিও পরিচালক বাদল খন্দকারসহ একই গাড়িতে ওঠেন। কিন্তু পুরো পথজুড়ে সামিরা নীরব—কোনো কথা নয়, কোনো প্রতিক্রিয়া নয়। বাদল খন্দকারের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে একটিও কথা হয়নি।
এফডিসির মূল ফটকে এসে সালমান গাড়ি থেকে নেমে যান। কিছুক্ষণ বাদল খন্দকারের সঙ্গে গল্প করে আবার ভিতরে ফিরে যান। কিন্তু সেদিন আর কোনো কাজ হয়নি।
রাত ১১টার দিকে বাদল খন্দকার তাঁকে নিউ ইস্কাটনের ফ্ল্যাটে নামিয়ে দেন। তারপরই যেন সবকিছু থেমে যায়। পরের দিন সকালে খবর আসে—সালমান শাহ আর নেই।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, শনিবার সকাল। টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা—সব জায়গায় একটাই সংবাদ: “নায়ক সালমান শাহ মারা গেছেন।” পুরো দেশ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, এমন প্রাণবন্ত, জনপ্রিয় একজন মানুষ হঠাৎ করে কীভাবে চলে যেতে পারেন!
পরিচালক শাহ আলমসহ সালমানের ঘনিষ্ঠজনরা বলেছিলেন, শেষ কিছু দিন তিনি মানসিক চাপে ছিলেন। পারিবারিক টানাপোড়েন, প্রযোজকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, এমনকি শিল্পী সমিতির নিষেধাজ্ঞা—সব মিলিয়ে এক অজানা হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলেন সালমান।
মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টি ছবিতে অভিনয় করে ঢালিউডে তিনি গড়েছিলেন এক অনন্য ইতিহাস। তাঁর প্রতিটি সিনেমাই আজও দর্শকের কাছে অমূল্য সম্পদ।
এত বছর পর আদালতের নতুন নির্দেশে সেই ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়টিতে আবার আলো পড়ছে। হয়তো এবার জানা যাবে—সেই রাতে আসলে কী ঘটেছিল, যখন থেমে গিয়েছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবনযাত্রা।
ভক্তদের মনে এখনও একটাই আশা—সালমান শাহর মৃত্যু শুধু স্মৃতিতে নয়, এবার হয়তো ন্যায়ের আলোয় ফিরে আসবে সত্যিটাও।

