গত কয়েক বছরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউ লক্ষ্য করা গেছে। মাত্র চার বছরে তিনটি দেশে সরকার পতন হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারেও বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আন্দোলনগুলোর ধরণ প্রায় একইরকম। প্রথমে নির্দিষ্ট কোনো দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। এরপর সেই দাবি মেনে না নেওয়া, সরকার দমনমূলক পদক্ষেপ, নিরাপত্তা বাহিনীর মোতায়েন এবং সরকারের দায়িত্বশীলদের বেফাঁস মন্তব্য আন্দোলনকে বড় আকার ধারণ করতে সহায়তা করে। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের পদত্যাগ বা সরকারের পতন ঘটে।
অনেকে দক্ষিণ এশিয়ার এই ঢেউকে আরব বসন্তের সঙ্গে তুলনা করছেন। এই ঢেউ শুরু হয় ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে। হাজার হাজার ক্ষুব্ধ জনতার চাপের মুখে তখন প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তিন বছর পর একই ধরনের আন্দোলন শুরু হয় বাংলাদেশেও। সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেফাঁস মন্তব্য এবং সহিংসতায় শতাধিক প্রাণহানি আন্দোলনকে সরকার পতনের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
নেপালেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়। প্রথম দিনে ১৯ জন নিহত হওয়ার পর আন্দোলন বড় আকার নেয়। বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতি ভবন এবং মন্ত্রীদের বাড়িঘরে আগুন ধরায় ও ভাঙচুর চালায়। চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী খড়গ প্রাসাদ ওলি পদত্যাগ করেন। তবে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত তিনিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করবেন।
বিশ্লেষকরা দেখছেন, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্ম শুধুমাত্র সরকারের পদত্যাগ নয়, বরং নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চাইছে। শুরুতে আন্দোলনগুলো নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুর কারণে হলেও শেষ পর্যন্ত জনগণের ক্ষোভ শাসকগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাসে পৌঁছেছে। তারা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীনরা বছরের পর বছর দুর্নীতি, বৈষম্য ও অদক্ষ শাসন চালিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন কঠিন করে তুলেছে।
এই তরুণ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনগুলো প্রায়ই সহিংস হয়ে উঠে, শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সরকারের পতনের পর দেখা দেয় রাজনৈতিক শূন্যতা, যেখানে অনির্বাচিত নেতৃত্ব ও দুর্বল আইনশৃঙ্খলা নতুন সংকট সৃষ্টি করে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, “শাসক শ্রেণিকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ হিসেবে দেখার ধারণা রাজনৈতিক সংকটের মূল ভিত্তি তৈরি করেছে।”
নেপালে সম্প্রতি আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। নতুন সরকারের কাঠামো ও ক্ষমতার বন্টন এখনো অনিশ্চিত। দেশের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে যে প্রথাগত শাসকগোষ্ঠী পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারে। ২০১৫ সালের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে নেপালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রী এক থেকে দুই বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি।
এর আগে ২০০৬ সালে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে শেষ হয় নেপালের রাজতন্ত্র। চলমান আন্দোলন পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। অধ্যাপক স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, “মূল প্রশ্ন হলো, নেপালে পুনরায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব হবে কি না।”
প্রতিবেশী দেশের অভিজ্ঞতা দেখায় দ্রুত সমাধান বা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা সহজ নয়। শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে রাজাপক্ষে পরিবারের পতনের পর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমেসিংহে দেশকে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তী নির্বাচনজয়ী সরকার জনজীবনের মান উন্নয়ন, সরকারি দুর্নীতি নির্মূল ও ক্ষমতাধরদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তেমন উন্নতি হয়নি। দেশবাসী এখনো অর্থনৈতিক সংকট, মানবাধিকার সমস্যা এবং বৈদেশিক ঋণের সঙ্গে লড়াই করছেন।
বাংলাদেশেও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স এক বছরের বেশি হলেও দেশে শৃঙ্খলা পুরোপুরিভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের সময়সীমা অনিশ্চিত থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় মব ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও জনবিক্ষোভ দেখা গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় সংসদ সদস্যদের সুবিধা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভে অন্তত সাতজন নিহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা মন্ত্রীদের পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।
পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, “অধিকাংশ আন্দোলন কোনো বড় পরিবর্তন ছাড়া শেষ হয়। তবে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতিতে ছোট ভুল বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নেপাল দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হবে।”