পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মশার উৎপাত আছে, যা মানুষের জন্য এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। বাংলাদেশে তো ঘরে বা বাইরে- সবখানেই মশার কামড় যেন নিত্যদিনের ঘটনা। তবে পৃথিবীতে এমন একটি দেশ আছে যেখানে মশার অস্তিত্ব নেই। দেশটি হলো আইসল্যান্ড।
আশপাশের দেশ নরওয়ে, গ্রিনল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডে একাধিক প্রজাতির মশা দেখা গেলেও আইসল্যান্ড এখনো পুরোপুরি মশামুক্ত। যদিও অ্যান্টার্কটিকাতেও মশা নেই, সেটি দেশ নয়, একটি মহাদেশ।
মশা না থাকার কারণ-
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আইসল্যান্ডে মশার অনুপস্থিতির পেছনে ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়া বড় ভূমিকা রেখেছে। দেশটি চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় মশাদের প্রাকৃতিকভাবে এখানে পৌঁছানো কঠিন। তবে শুধুমাত্র দূরত্বই কারণ নয়, কারণ উড়োজাহাজে ভ্রমণ করা মশারা আইসল্যান্ডে পৌঁছাতেও পারে।
আইসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লিমনোলজির এমেরিটাস অধ্যাপক গিসলি মার গিসলাসন ২০১৭ সালে রেইকিয়াভিক গ্রেপভাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি একবার গ্রিনল্যান্ড থেকে আসা ফ্লাইটে মশা ধরেছিলেন। তার মতে, বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারে মশারা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সহ্য করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, মশারা যদি পৌঁছায়ই, তবে কেন তারা সেখানে বংশবিস্তার করতে পারছে না? গিসলাসনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আইসল্যান্ডের আবহাওয়া মশাদের জীবনচক্রের জন্য একেবারেই অনুকূল নয়। এখানে উপযুক্ত প্রজননস্থল থাকলেও (যেমন জলাভূমি বা ছোট পুকুর) বারবার জমাট বাঁধা ও গলার আবহাওয়া মশাদের জীবনধারায় বাধা সৃষ্টি করে।
মশার জীবনচক্র ও আইসল্যান্ডের আবহাওয়ার প্রভাব-
মশার জীবনচক্রে চারটি ধাপ আছে— ডিম, লার্ভা, পিউপা এবং পূর্ণবয়স্ক মশা। প্রাপ্তবয়স্ক মশা পানিতে ডিম দেয়। ডিম থেকে লার্ভা, এরপর পিউপা এবং শেষে পূর্ণবয়স্ক মশা তৈরি হয়। তবে এই পুরো প্রক্রিয়ায় পানির জমাট না বাঁধা জরুরি।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের পোকাবিজ্ঞানী রবার্ট জোন্স জানান, কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের মতো কিছু এলাকায় মশারা ডিম অবস্থায় মাসের পর মাস নিদ্রায় (ডরমান্সি) থাকে। মধ্য ইউরোপে মশারা শীতকাল কাটায় গর্তে বা পানিতে ডিম অবস্থায়।
কিন্তু আইসল্যান্ডের আবহাওয়া মধ্যবর্তী ধরণের। দীর্ঘ শীতকাল এবং শরৎ ও বসন্তে বারবার জমাট বাঁধা ও গলার চক্র মশাদের ডিম ও লার্ভার বৃদ্ধি ব্যাহত করে। ফলে তারা পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যায়।
আইসল্যান্ডে কিছু ভূ-তাপীয় উষ্ণপুকুর আছে, যেখানে শীতে বরফ জমে না। কিন্তু এগুলোর পানি অতিরিক্ত গরম হওয়ায় মশার লার্ভা টিকে থাকতে পারে না। তাছাড়া পানির রাসায়নিক গঠনও মশাদের জন্য প্রতিকূল।
জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব-
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আইসল্যান্ড হয়তো বেশি দিন মশামুক্ত থাকবে না। বসন্ত ও শরৎ উষ্ণ হলে পানির জমাট বাঁধা কমে যেতে পারে, যা মশাদের বংশবিস্তার সহজ করবে।
নিউ মেক্সিকো স্টেট ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ইম্মো হ্যানসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলেও মশার বিস্তার বাড়ছে, কারণ শীতকাল উষ্ণ হচ্ছে।
হাওয়াইয়ের উদাহরণও উল্লেখযোগ্য। একসময় দ্বীপপুঞ্জটি মশামুক্ত ছিল, কিন্তু ১৮২৬ সালে জাহাজের মাধ্যমে মশা পৌঁছায় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে হাওয়াইয়ের উচ্চভূমিতেও মশার দেখা মেলে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি-
জোন্সের মতে, যদি মশারা আইসল্যান্ডে পৌঁছায়ও, তবে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ ছড়ানো মশাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম। এই মশারা উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ুতে বেশি উপযোগী।
তার গবেষণা অনুযায়ী, ২০৮০ সাল পর্যন্ত উত্তর ইউরোপে ডেঙ্গুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তবে জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে আইসল্যান্ডে মশার আগমন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। আপাতত পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে মশামুক্ত থাকার স্বীকৃতি আইসল্যান্ড ধরে রেখেছে।