গত বছরের আগস্টে নাটকীয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে দেশে নানামুখী সংস্কারের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের কাজও এগিয়ে চলছে। অভিযানের অগ্রভাগে থাকা খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তার নিজস্ব ঘর গোছাতে বেশ কঠোর হয়েছে এবং কঠোর হতে চলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে দুদকের অভ্যন্তরে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে সংস্থাটি এরই মধ্যে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তির আওতায় আনা শুরু করেছে। বিষয়টি দুদকের ভেতরে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও জনআস্থা ফেরাতে এটি ইতিবাচক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযোগের প্রমাণ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে প্রমাণহীন অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া না হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে এরই মধ্যে ঘুষ, দুর্নীতি, অনৈতিক সুবিধা নেওয়া এবং নির্ধারিত সময়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে দুদকের দুই পরিচালকসহ সাত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একজনকে চাকরিচ্যুত এবং দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি করাসহ রদবদলের মতো শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ পেলেই দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। এসব ঘটনায় সংস্থাটির ভেতরে আতঙ্ক ও ভীতি কাজ করছে।
এছাড়া, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দুদকে বরখাস্ত ও রদবদলের ঝড় বয়ে গেছে। এই সময়ে দুই পরিচালক, তিন উপপরিচালক ও একজন উপসহকারী পরিচালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং দুই উপসহকারী পরিচালককে রিজার্ভ (ওএসডি) শাখায় বদলি করা হয়েছে। এছাড়া চলতি বছর দুই ডজনের বেশি কর্মকর্তাকে রদবদল করা হয়েছে।
সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন সূত্র জানিয়েছে, আগামী কিছুদিনের মধ্যে অন্তত ৩০-এর বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন পর্যায়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।
শাস্তি ও বদলির মুখোমুখি হলেন যারা-
চলতি বছরের ১৯ মার্চ সাময়িক বরখাস্ত করা হয় দুদকের সহকারী পরিচালক এস এম মামুনুর রশীদকে। তার বিরুদ্ধে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামুনুর রশিদের প্রাক্তন স্ত্রী ফারহানা ইয়াসমিন মিমের করা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা এবং যৌতুকের অভিযোগকে এক্ষেত্রে আমলে নেওয়া হয়েছে। দুদকের আদেশে ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হওয়াসহ দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ এর ২(ঝ) (৫) অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়।
গত ১৬ এপ্রিল ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগে উপ-সহকারী পরিচালক সুদীপ কুমার চৌধুরীকে চাকুরিচ্যুত করে দুদক। তাকে দুদক (কর্মচারী) চাকুরি বিধিমালা, ২০০৮ এর ৩৯(খ), ৩৯(৪), ৩৯(চ) ও ৪০(১) (খ)(৫) ধারায় চাকরি থেকে স্থায়ী বরখাস্ত করা হয়।
দুদকের নথিপত্রে অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে, বগুড়ায় উপসহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকাকালে সুদীপ কুমার চৌধুরী জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপপরিদর্শক আলমগীর হোসেনের সম্পদ বিবরণী যাচাই করেন। সে সময় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সুদীপ কুমার ৭ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। আলমগীরের খালাতো বোন বেগম সুমাইয়া শিরিন, বগুড়া বারের আইনজীবী মো. কামাল উদ্দিন ও সৈয়দ আসিফুর রহমানের মাধ্যমে তিনি দেড় লাখ টাকার বেশি উৎকোচ গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত মোবাইলে উৎকোচ দাবি ও গ্রহণের কথোপকথনের অডিও রেকর্ড দুদকের ফরেনসিক ল্যাবের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ২০ জুলাই তাকে সাময়িক বরখাস্তের পর এখন স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়।
গত ৬ আগস্ট দুদকের উপপরিচালক মো. আহসানুল কবীর পলাশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো সময়মতো অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল না করা। এ বিষয়ে দুদকের আদেশে বলা হয়, অভিযোগের বিষয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে আহসানুল কবীর পলাশকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি সংশ্লিষ্ট নথি বিষয়ক কোনো প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় এবং সময় বৃদ্ধির আবেদনও না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারী বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ১৬ জুলাই কমিশন সভায় ৪৩(১) বিধি মোতাবেক তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
একই কারণে গত ১৭ জুলাই সাময়িক বরখাস্ত করা হয় প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক কমলেশ মন্ডলকে। বরখাস্তের আদেশে বলা হয়, তার বিরুদ্ধে কর্মকালীন সময়ে ঢাকা ওয়াসার ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের পিডি ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আখতারুজ্জামানসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এ প্রকল্পে মাঠপর্যায়ে লোকবল নিয়োগ এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে দুর্নীতি করার অভিযোগের অনুসন্ধান প্রতিবেদন সময়মতো দাখিল করতে না পারার অভিযোগ রয়েছে।
ওই অভিযোগের বিষয়ে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল না করা এবং সময় বৃদ্ধির আবেদন না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারী বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ১০ জুলাই কমিশন সভায় ৪৩(১) বিধি মোতাবেক তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চলতি বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসেও ডজনের বেশি কর্মকর্তাকে নানা কারণে বদলি করার ঘটনা ঘটেছে। দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয় গত সেপ্টেম্বর মাসে। ওই মাসে সবচেয়ে বেশি ও বড় পদের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে, গত ৪ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নাম করে অর্থ আত্মসাৎসহ অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে উপপরিচালক মাহবুবুল আলম এবং উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জুলফিকারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
ওই আদেশে বলা হয়েছে, দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ ও কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ আগস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় অভিযোগের গুরুত্ব ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ মোতাবেক তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিধিমালার ৪৩(১) বিধি অনুযায়ী এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পরে ৮ সেপ্টেম্বর বরখাস্ত হন দুদকের পরিচালক ড. খান মো. মীজানুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে এভারকেয়ার হাসপাতালের পরিচালক মাহাবুবুল আনামের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আদেশে বলা হয়, কমিশনের গোপন তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে— তিনি গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং চিকিৎসা শেষে গত ২০ আগস্ট বকেয়া চিকিৎসা বিল বাবদ দুই লাখ চার হাজার ১৩২ টাকা নিজে পরিশোধ করেননি। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাহবুবুল আনাম কর্তৃক এ টাকার জিম্মা (গ্যারান্টি) প্রদানপূর্বক হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের ‘অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি’র সভায় অভিযোগটি উপস্থাপন করা হয়। সভায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই মধ্যে ব্যক্তিগত শুনানি শেষ হয়েছে।
অপরদিকে একই দিন তিন পরিচালক মো. রফিকুজ্জামান, মো. কামরুজ্জামান ও খন্দকার জাকির হোসেনকে প্রধান কার্যালয়ের তিন দপ্তরে অদল-বদল করে বদলি করা হয়েছে। এরপর গত ২১ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে পরিচালক পদমর্যাদার একমাত্র সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. রাজিব হাসানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্তসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের এ সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়, গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে দুদক ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করে মো. রাজিব হাসান বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটির সভায় অভিযোগটি উপস্থাপিত হয় এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। অভিযোগের গুরুত্ব ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী তাকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত হয়।
একই দিন অপর আদেশে সহকারী পরিচালক মাসুম আলী, মো. ইসমাইল, উপসহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন ও মোহাম্মদ আলী হায়দারকে বদলি করা হয়।
২৩ সেপ্টেম্বরের আরেক আদেশে বাগেরহাটের উপসহকারী পরিচালক মো. আবুল হাসেমকে ওএসডি (রিজার্ভ শাখা) করে প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। একই দিন অপর এক আদেশে সহকারী পরিদর্শক মো. রুহুল আমিন, গাড়িচালক শাহরিয়ার হাসান ও মো. আল আমিন খানকে ঢাকা ও সিলেট থেকে বদলি করা হয়েছে।
এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর বদলি ও ওএসডি করা হয়েছে তিন কর্মকর্তাকে। যার মধ্যে সহকারী পরিচালক মো. আনিছুর রহমানকে ঢাকা থেকে বাগেরহাট, মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামকে ঢাকা থেকে পিরোজপুর এবং উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান কার্যালয়ে রিজার্ভ শাখায় দেওয়া হয়েছে। একই দিন পরিচালক আবুল হোসেন ঢাকায় ও রিজিয়া রহমানকে চট্টগ্রামের দুদক অফিসে বদলি করার তথ্য রয়েছে।
সর্বশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুদকের তিন উপপরিচালক ও একজন উপসহকারী পরিচালককে বদলি করা হয়েছে।
‘উড়ো অভিযোগ’ নয়, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা-
অনিয়ম বা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তির মুখোমুখি করাকে কমিশনের ভেতরে-বাইরে সবাই স্বাগত জানাচ্ছে। তবে দুদক কর্মকর্তাদের মতে, অভিযোগ ওঠা আর প্রমাণ পাওয়া দুটি ভিন্ন বিষয়। শুধু অভিযোগ উঠলেই কাউকে দোষী ভাবা ঠিক নয়; গুরুতর অভিযোগ ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে তবেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা কখনোই অপরাধের বিচার বা শাস্তির বিপক্ষে নই। তবে আমরা যে ধরনের কাজ করি, তা কখনোই কারও জন্য শুভকর বা স্বস্তিদায়ক নয়। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক ক্ষমতাধর হন। তাদের বিরুদ্ধে কাজ করাই বড় চ্যালেঞ্জের। সুবিধা না পেয়ে তারা বিভিন্ন সময় বেনামি ও উড়ো অভিযোগ করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনেক সময় তা সঙ্গে সঙ্গে আমলে নেয়। অনেক সময় কোনো ধরনের কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই বিভাগীয় শাস্তি পেতে হয়। অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে আপত্তি নেই।
‘এমনও দেখা গেছে, অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় টাস্কফোর্সের আওতায় গঠিত যৌথ টিমের সদস্যকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ যৌথ টিম গঠনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুরোধ বা নির্দেশনা ছিল যে কোনো সদস্যকে অহেতুক যেন বদলি করা না হয়।’
কর্মকর্তা ও কর্মচারী পর্যায়ে আরও কয়েকজন বলেছেন, দুদকের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। কমিশনের ভেতরে কেউ যদি অনিয়ম বা স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, তবে তাকে ছাড় দেওয়া উচিত নয়।
‘সম্প্রতি যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কমিশন সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে। তবে অভিযোগ ওঠা আর প্রমাণ পাওয়া— দুটি বিষয় এক নয়। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই তাকে দোষী ভাবা যায় না। গুরুতর ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
তারা আরও বলেন, অনুসন্ধান ও তদন্তের কাজে দুদকের প্রতিটি কর্মকর্তা অতিরিক্ত চাপে থাকেন। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর দ্রুতগতিতে মামলা ও চার্জশিট দেওয়ার যে চাপ রয়েছে, তাতে অনেক কর্মকর্তা মানসিকভাবে বিধ্বস্তের মতো অবস্থায় আছেন। সীমিত লজিস্টিক সাপোর্ট ও জনবল নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তার ওপর দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তাদেরই প্রকৃত কাজের দায়িত্ব নিতে হয়। ডেপুটেশনে যারা আসেন, তাদের অধিকাংশই তদারককারী ও বুদ্ধিদাতা হিসেবে কাজ করে থাকেন।
‘অনুসন্ধান ও তদন্ত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং ধন্যবাদ অযোগ্য কাজ। দুদকের কাজে জীবনের ঝুঁকি ও চাকরির ভয় সবসময় থাকে। তাই ছোটখাটো ও অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি মার্জনার চোখে দেখা উচিত। যারা সততার সঙ্গে ভালো কাজ করছেন, তাদের পুরস্কৃত করাসহ বাড়তি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা উচিত। শাস্তি ও পুরস্কার— দুটিই সমানভাবে কার্যকর হলে প্রতিষ্ঠান আরও শক্তিশালী ও জনআস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারবে। আমরা চাই, কমিশনের প্রতিটি কর্মকর্তা নিরপেক্ষতা, সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুন, যাতে জনগণের আস্থা আরও দৃঢ় হয়।’
অনুসন্ধান ও তদন্তে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে-
দুদকের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের অফিস যদি দুর্নীতিমুক্ত না হয়, তাহলে অন্য অফিসকে বলার নৈতিক অধিকারই থাকে না যে— তোমরা কেন দুর্নীতি করো? আমাদের নিজেদের মধ্যে যেটুকু দুর্নীতি রয়েছে, সেটা মুক্ত করতে হবে। আমরা সেটাই করার চেষ্টা করছি।’
এ বিষয়ে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নির্মূল কমিটির সভায় আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে, তারপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার সুপারিশ করে কমিটি। সুপারিশের ভিত্তিতে সাময়িক বরখাস্তকরণসহ বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে যদি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কোনো অপরাধ পাওয়া যায়, সে বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত হওয়ার পর চূড়ান্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।’
দেশেকে দুর্নীতিমুক্ত করতে দুদকে শুদ্ধি জরুরি-
আইনজীবীসহ একাধিক পেশাজীবী দুদকের এমন পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তারা বলছেন, দুদক নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা অত্যন্ত ইতিবাচক উদ্যোগ। এই বার্তা সবার কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার যে, অনিয়ম করলে কেউ রেহাই পাবে না। আমরা চাই এই ধারা অব্যাহত থাকুক। দুদকের শুদ্ধি অভিযানকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাদিম মাহমুদ বলেন, দুদকের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযানকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। নিরপেক্ষভাবে ভিন্ন সংস্থা দিয়ে তদন্ত করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। দুদক যদি দুর্নীতিমুক্ত হয় ও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে দেশের দুর্নীতি এমনিতেই কমে যাবে।
‘আমরা চাই সরকারের নির্ধারিত মূল্যে সরকারি সেবা নিশ্চিত হোক। কোথাও ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। প্রয়োজনে দুদকের জনবল ও লজিস্টিক সহায়তা বৃদ্ধি করা হোক। দুদককে জনগণের যথাযথ সেবা নিশ্চিত করতে হবে’- বলেন নাদিম মাহমুদ।
সূত্র: ঢাকা পোস্ট