রাগের সময় আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখন আমরা খরচ নিয়ে ভাবি না। কোন জিনিস কেনার আগে বিচক্ষণ চিন্তা প্রায় থাকে না কিন্তু কেনার পরই শুরু হয় আফসোস। ‘এত কিছু কেন কিনলাম?’—এই প্রশ্ন বারবার মাথায় আসে। তবুও একই ভুল আমরা বারবার করি। আবার অর্ডার দিই, আবার কেনি। মানসিক রাগ আমাদের খরচের নিয়ন্ত্রণকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
অর্থনীতিতে ‘ইমোশনাল স্পেন্ডিং’ নামে একটি টার্ম আছে। এর মানে—মন খারাপ বা রাগের সময় পছন্দের কিছু কিনে মানসিক চাপ কমানো। সাধারণভাবে আমরা একে ‘নিজেকে ট্রিট দেওয়া’ বলি। রাগের সময় আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখন আমরা খরচ নিয়ে সচেতন হই না। কিন্তু কেনার পরই শুরু হয় আফসোস। ‘এত কিছু কেন কিনলাম?’—প্রশ্ন ঘুরতে থাকে মাথায়। তবুও একই ভুল আমরা বারবার করি। আবার অর্ডার দিই, আবার কেনি। এফ কমার্সের ক্রমবর্ধমান প্রভাবও এখানে কাজ করছে। যত বড় হচ্ছে অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম, মানুষ তত বেশি শপাহোলিক হয়ে উঠছেন।
অ্যাড কার্টের জালে পড়া: যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের কেনাকাটায় ফাঁদে ফেলে:
আমরা প্রায়ই ভেবেই পড়ি অ্যাড কার্টের ঝুড়িতে। পেমেন্ট অ্যান্ড কমার্স মার্কেট ইন্টেলিজেন্স (পিসিএমআই)-এর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ ই–কমার্স ল্যান্ডস্কেপ’ (নভেম্বর ২০২৪) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৮০ শতাংশ অনলাইন কেনাকাটা মোবাইল থেকে হয়। বাকি ২০ শতাংশ হয় কম্পিউটার বা ডেস্কটপে। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীর পছন্দ–অভিরুচি অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেখায়। আমরা ভাবি—‘একটু দেখি’। অল্প সময়ের মধ্যে আঙুল নাড়াতে নড়াতে ঘুরে গিয়ে অনেক সময় পছন্দের জিনিস কার্টে চলে আসে। তরুণরা তো বটেই, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধরাও এতে ফাঁদে পড়ে।
কিছু কেনার সময় আমাদের মস্তিষ্কে ‘ডোপামিন’ নামের হরমোন নিঃসৃত হয়। এটি সাময়িক আনন্দ দেয়। ঘরে বসে বা কাজের ফাঁকে অর্ডার করলে আনন্দ আরও বেড়ে যায়। লাইভ কমেন্ট ও প্রশ্নোত্তর ফিচার থাকায় পণ্য সম্পর্কে জানতে পারা সহজ হয়। ফলে যা দরকার নেই, সেটাও কার্টে চলে আসে। আরেকটি কারণ হলো—মানিব্যাগ বা পকেটে টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার চিন্তা নেই। অর্ডার যতদিনে ডেলিভারি হবে, খরচ তখনই মিটে যাবে। পুরো প্রক্রিয়াটি এতটাই অবচেতনভাবে ঘটে যে অনেকেই টের পান না।
ইশরাত ইমরান এর অভিজ্ঞতা এ বিষয়টি বোঝায়। তিনি বলেন, “যতবার ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে ঢুকি, সামনে থাকা কোনো বিজ্ঞাপন দেখে বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করি। দিনে ২-৩ ঘণ্টা সময় চলে যায় শুধু এই পেজগুলোতেই। ফেসওয়াশ কিনতে গিয়ে আরও কয়েকটি পণ্য পছন্দ হয়ে যায়, তখন কিনে ফেলি।”
এফ–কমার্সের দাপট:
আজকাল ওয়েবসাইটভিত্তিক অনলাইন ব্যবসাগুলোর প্রায় সবকটিরই ফেসবুক পেজ রয়েছে। এটি ব্যবসার পরিসর অনেক বড় করেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২,০০০ স্বতন্ত্র ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং ৩ লক্ষাধিক এফ–কমার্স পেজ সক্রিয় ছিল। তখন এসবের ব্যবসায়িক পরিসর ছিল প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকায়। এখন বাংলাদেশের ই–কমার্স বাজারের ৪০–৫০ শতাংশই আসে এফ–কমার্স থেকে।
ফেসবুক কেনাকাটা এখন বিনোদনের অংশ:
মানুষ ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে ঢুকে পড়ে পণ্যের বাজারে। আজকাল এফ–কমার্স আর বিনোদন মিশে গেছে একসাথে। আগে যখন মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ঘরে ঘরে পৌঁছেনি, তখন পরিবার সন্ধ্যায় টিভির সামনে বসত সিরিয়াল বা অনুষ্ঠান দেখতে। এখন সেই জায়গা দখলে নিয়েছে ফেসবুক লাইভ। পেজগুলো আগেই জানিয়ে দেয়—‘আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটায় লাইভে আসব নতুন শাড়ি ও গয়না নিয়ে। থাকবেন সবাই।’ ভক্তরা নির্ধারিত সময়ে মুঠোফোন হাতে হাজির হন, কেনার ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক।
দ্য ইকোনোমিস্ট–এর ‘আর ইউ অ্যাডিকটেড টু শপিং’ প্রতিবেদনে ‘জার্নাল অফ বিজনেস রিসার্চ’-এর একটি গবেষণার উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ব্র্যান্ডগুলো সীমিত সময়ের ছাড় বা বিশেষ গ্রাহক অভিজ্ঞতা দেখিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ (ফোমো) তৈরি করে। এই ভয়ে অনেকেই প্রয়োজন ছাড়াও জোরপূর্বক কিনে ফেলেন।
অনেকে ‘সেল’ বা ‘অফার’ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন—ভাবেন, এই দামে আর পাওয়া যাবে না। গবেষণাও প্রমাণ করছে, কেনাবেচার এই প্রবণতা মূলত দাম কম থাকার কারণে। পিসিএমআই-এর ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাংলাদেশ ই–কমার্স ল্যান্ডস্কেপ’ (নভেম্বর ২০২৪) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭৯ শতাংশ মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা পছন্দ করেন, কারণ সেখানে দাম তুলনামূলকভাবে কম।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইসমত জাহান বলেন, “অনেকেই সারাদিন এসব বিজনেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকে থাকেন। মেসেজ বা নিউজফিডে তাদের পাওয়া যায় না—এটা একধরনের আসক্তি।” অনেকে নিজেকে বোঝান, যদি কেনাকাটা বা ভিডিও গেমের মতো কিছুর সঙ্গে যুক্ত না থাকতেন, তবে হয়তো মাদক বা আত্মবিধ্বংসী কিছু করতেন কিন্তু ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা সতর্ক করছেন—কোনো আসক্তিই ভালো নয়।
গবেষণা প্ল্যাটফর্ম রিসার্চগেটে প্রকাশিত ‘ফ্যাক্টরস ডিটারমিনিং স্যাটিসফেকশন অফ অনলাইন কাস্টমার্স ইন ঢাকা সিটি, বাংলাদেশ’ (মার্চ ২০২১) শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সময় স্বল্পতা, অবস্থানগত সুবিধা এবং পণ্যের বৈচিত্র্য—এই তিন কারণ মানুষকে অনলাইনে কেনাকাটায় প্রলুব্ধ করে।
শাম্মি আক্তার সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একটি স্বনামধন্য বেসরকারি ব্যাংকে এমটিও পদে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার অফিস থাকে পাঁচদিন। বাকি দুদিন বিশ্রাম নিই বা ঘুরতে যাই। বিশ্বস্ত অনলাইন পেজগুলো সময়মতো পণ্য পৌঁছে দেয়, তাই বাইরে গিয়ে কেনাকাটার প্রয়োজন হয় না।” তিনি সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট পেজ থেকেই কেনাকাটা করেন। সেসব পেজের সঙ্গে একধরনের বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নতুন কিছু ভালো লাগলে সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার দেন। “আমি তো প্রডাক্টগুলো ব্যবহার করে ঠকছি না। বরং নতুন জিনিস ব্যবহার করে আনন্দ পাই,” বলেন শাম্মি।
তবে এই বিনোদনমূলক শপিং সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। তারা বলছেন, বিষয়টি কিছুটা গ্যাম্বলিংয়ের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। মানুষ পরিমিতবোধ হারাচ্ছে—কতটা দরকার, সেটি আর বোঝে না। বিভিন্ন দেশে করা গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ ‘অনিওম্যানিয়া’ বা শপিং আসক্তিতে ভুগছেন। এটি শুধুমাত্র অতিরিক্ত কেনাকাটা নয়; এই আসক্তি সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে এবং ঋণের বোঝায় ফেলে দিতে পারে।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইসমত জাহান বলেন, “এক কেসে দেখি, স্ত্রীর অভিযোগ—স্বামী অযথা খরচ করেন। এমনকি খরচের কারণে সন্তানের টিউশন ফি দেওয়া যাচ্ছে না। আবার এক পুরুষ রোগী প্রায় প্রতিদিন কিছু না কিছু অর্ডার করতেন, অথচ সেগুলো ব্যবহার করতেন না। এভাবে পুরো ঘর ভরে যেত। অনেক দাম্পত্য কলহের পেছনে ‘কমপালসিভ বায়িং ডিজঅর্ডার’ কাজ করে।”
তবু এই আসক্তি থেকে দূরে থাকা কঠিন। কারণ এতে যুক্ত হয়েছে সামাজিক অবস্থান ও স্ট্যাটাসের ধারণা। মার্কিন সমাজ থেকে এসেছে এই ধারণা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যুগে পণ্য সহজলভ্য ও সস্তা হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ক্রয়ক্ষমতা সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। এখন সেই ধারা আমাদের সমাজেও দেখা যাচ্ছে।
ইসমত জাহান বলেন, “যেকোনো আসক্তির পেছনে আশপাশের মানুষের প্রভাব থাকে, যাকে বলে ‘পিয়ার প্রেশার’। মাদকাসক্তির মতোই, কমপালসিভ বায়িং ডিজঅর্ডারেরও থাকে ‘ব্যাড কোম্পানি’। যারা আপনাকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে উৎসাহিত করে। মনে হয়, সবাই কিনছে, আমি না কিনলে আলাদা হয়ে যাব। এখানেই ভুলটা হয়।” তিনি আরও বলেন, “আসক্তি কমাতে চাইলে ওই পেজগুলো আনসাবস্ক্রাইব করতে হবে। ডিভাইস থেকে দূরে গিয়ে বাগান করা, হাঁটতে যাওয়া বা সামনাসামনি আড্ডা দেওয়া—এসব অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে।”

