নতুন স্কুল বছর শুরু হলে অনেক বাংলাদেশি অভিভাবক চায় তাদের সন্তান শুধু ক্লাসরুমে ভালো হোক না খেলার মাঠেও দক্ষ হোক। যদিও খুব কম অভিভাবক আশা রাখেন যে তাদের সন্তান পেশাদার অ্যাথলিট হবে, তারা চায় সন্তান খেলাধুলার শারীরিক এবং সামাজিক উপকারিতা উপভোগ করুক। তবে সন্তানকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করার চেষ্টা করার সময় অভিভাবকরা প্রায়শই বিপরীতমুখী পরামর্শের ঝড়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। স্কুল শিক্ষক, কোচ বা পরিবারের অভিজ্ঞতা অনেক সময় আরও জটিলতা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে যেমন শিশুদের ফুটবল, হকি বা ক্রিকেট একাডেমি থেকে শুরু করে পার্ক বা আঙ্গিনার খেলা পর্যন্ত নানা সুযোগ রয়েছে, অভিভাবকদের জন্য সঠিক পরামর্শ জানা এবং শিশুর জন্য সঠিক পথ তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
সৌভাগ্যবশত, খেলাধুলা বিজ্ঞানের গবেষণা স্পষ্ট প্রমাণ দেয় কীভাবে শিশু খেলায় আরও দক্ষ হতে পারে। এখানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো, যা অভিভাবক এবং কোচদের খেলার ভাবধারাকে বদলাতে পারে এবং শিশুদের মাঠে উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে।
১. শিশুকে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বাইরে খেলতে দিন
অনেক অভিভাবক চায় তাদের সন্তানরা ফাঁকা সময়ও কোচিং বা প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকুক। কিন্তু শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নয়, শিশুরা যখন বড়দের চোখের আড়ালে খেলায় সময় কাটায়, তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা শেখে। তাই অভিভাবকরা যেন তাদের স্বাধীনভাবে শেখার সুযোগ দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, জার্মানির ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ বিজয়ীরা আনুষ্ঠানিক ফুটবলে কম সময় কাটিয়েছেন, কিন্তু কিশোরবেলায় বন্ধুত্বপূর্ণ ও অ-গঠনমূলক ফুটবল অনেক খেলেছেন। এভাবে তারা কোচের নির্দেশ ছাড়াই নিজেরা খেলা ও শেখার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও শিশুরা পার্ক, রাস্তাঘাট বা স্কুল মাঠে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলাধুলায় অংশ নিতে পারে। এই খেলাগুলো শুধুই আনন্দ এবং স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ থেকে হয়, অভিভাবককে খুশি করার জন্য নয়।
অ-গঠনমূলক খেলা শিশুদের শারীরিক ও কৌশলগত দক্ষতা বাড়ায়। ছোট মাঠে খেলার কারণে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে বেশি বল স্পর্শের সুযোগ মেলে। বড় ও শক্তিশালী খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতাও তাদের শেখার গতি ত্বরান্বিত করে, ভুল করার সুযোগ দেয় এবং নতুন কৌশল চেষ্টা করতে শেখায়।
লাফবারো ইউনিভার্সিটির মার্ক উইলিয়ামস বলেন, “রাস্তার খেলা শিশুর সৃজনশীলতা ও কৌশলগত দক্ষতা বাড়ায়। খেলোয়াড় এবং প্রতিপক্ষের সংখ্যা ও পরিবেশ বদলায়, তাই তারা সব সময় নতুন পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে শেখে।”
এস্টন ভিলা এবং ইংল্যান্ডের জেডন স্যানচো বলেন, “রাস্তার খেলার মাঠে কোনোকিছু হারানোর ভয় নেই, তাই সবাই নিজের মতো খেলতে পারে। ঠিক এভাবেই আমরা আমাদের দক্ষতা শিখি।”
শিশুদের অ-গঠনমূলক খেলা তাদের গেম ইন্টেলিজেন্স বা মাঠে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায়। তাই অভিভাবকরা যেন খুব বেশি হস্তক্ষেপ না করে শিশুদের স্বাধীনভাবে খেলতে দেয়, যা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ শেখায়—নিজে ভাবার ক্ষমতা।
২. খুব অল্প বয়সে বিশেষায়িত হওয়া ঠিক নয়

যদি শিশু এক খেলায় ভালো করছে, তখন অভিভাবকরা প্রায়ই ভাবেন, সব সময় এবং মনোযোগ সেই খেলায় দিচ্ছে কি না। কিন্তু খুব অল্প বয়সে কোনো এক ক্রীড়ায় বিশেষায়িত হওয়া শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য এবং খেলায় আনন্দকে হুমকির মুখে ফেলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, খুব অল্প বয়সে বিশেষায়িত শিশুদের চোটের ঝুঁকি বেশি। শিশুদের বয়সের চেয়ে বেশি ফরমাল ট্রেনিং করা এবং সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় শুধু সেই খেলায় ব্যয় করা হলে তারা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ে।
বিভিন্ন খেলায় অংশ নেওয়া এক খেলাকে অন্য খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত করে এবং মোট দক্ষতা বাড়ায়। যেমন, জ্যানিক সিনার প্রথমে স্কিইং-এ পারদর্শী ছিলেন, যা পরে টেনিসে তার সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। একইভাবে, অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান স্টিভ স্মিথ টেনিস থেকে মানসিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শিখেছেন।
গবেষণা দেখিয়েছে, অলিম্পিক বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা কিশোরবেলায় একাধিক খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। তাই, শিশুরা ভারসাম্যপূর্ণ শৈশব উপভোগ করলেও তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সঠিকভাবে বিকাশিত হতে পারে।
৩. ছোট বয়সী খেলোয়াড়দের সম্ভাবনা উপেক্ষা করবেন না
কয়েক কোটি টাকা খরচ করেও অনেক সময় ক্লাবগুলো শিশুদের মধ্যে প্রতিভার ভুল মূল্যায়ন করে। ধরুন, এক সময় বাংলাদেশের কোনও ফুটবল একাডেমি ১৩ বছর বয়সী এক খেলোয়াড়কে বাদ দেয়, পরবর্তীতে ওই খেলোয়াড় হয়ে ওঠে দলের মূল আকর্ষণ। সেই সময় সে তার কক্ষেই এক সপ্তাহ কাঁদত। তিন বছর পর তাকে আবার অন্য ক্লাবেও ছাড়তে হয়।
এই খেলোয়াড়ের প্রতিভা সহজেই উপেক্ষিত হয়েছিল। প্রধান কারণ, সে তার বছর গোষ্ঠীর জন্য তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। এছাড়া, তার গড়নও ছিল আলতো—সেজন্য কিছু কম দক্ষ কিন্তু বড় এবং শক্তিশালী খেলোয়াড় তাকে সহজেই পিছনে ফেলতে পারত।
এটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও দেখা যায়। অনেক সময় ফুটবল বা হকি একাডেমিগুলো একই বছর জন্ম নেওয়া খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যদি একজন খেলোয়াড় জুন বা জুলাই মাসে জন্মায়, সে স্বাভাবিকভাবেই শারীরিকভাবে কিছুটা পিছিয়ে থাকে। আবার বয়সের দিক থেকে বড়দের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন সে ভুলভাবে “দক্ষ নয়” বা “স্লো” হিসেবে চিহ্নিত হয়।
একজন প্রখ্যাত খেলোয়াড়ও পরে জানায়, “আমি তখন আমার বয়সের তুলনায় ছোট ছিলাম এবং শারীরিকভাবে দেরিতে বৃদ্ধি পেয়েছিলাম। তখন বোঝা কঠিন ছিল আমি কেমন খেলোয়াড় হতে যাচ্ছি।”
অতএব, বাংলাদেশে যেমন স্কুল বা একাডেমি পর্যায়ে শিশুদের নির্বাচন করা হয়, অভিভাবক এবং কোচদের উচিত জন্মমাসের কারণে শিশুকে বাদ না দেওয়া। প্রত্যেক শিশুকে সমান সুযোগ দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ প্রতিভার কারণে পিছিয়ে না পড়ে।
৪. দক্ষ শিশুদের বড়দের সঙ্গে খেলতে দিন
বেঞ্চমার্ক হিসেবে ভিনাস এবং সারিনা উইলিয়ামস দেখানো যায়। ছোট বোন সারিনা বড় বোন ভিনাসের চেয়ে পরে আরও সফল হন। একাধিক গবেষণা দেখিয়েছে, ছোট বোন বা ভাই প্রায়শই বড় ভাইবোনের সঙ্গে খেলায় উন্নতি লাভ করে।

যখন শিশু বড় এবং দক্ষ খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলে, তারা দ্রুত শিখতে বাধ্য হয়। ব্যর্থতার মাধ্যমে শেখার এই অভিজ্ঞতা তাদের ধৈর্য, প্রতিযোগিতা এবং কৌশলগত দক্ষতা বাড়ায়। তাই শিশুদের মাঝে “optimal challenge point” তৈরি করা উচিত, যেখানে তারা নিয়মিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
নিউজিল্যান্ড রাগবি একটি উদাহরণ। সেখানে কিছু ম্যাচ বয়স অনুযায়ী এবং কিছু ওজন অনুযায়ী হয়, যাতে বড় খেলোয়াড় শুধুমাত্র শক্তির উপর নির্ভর করতে না পারে।
৫. অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলুন
স্কুল ম্যাচ দেখলে স্পষ্ট হয়, অভিভাবকরা প্রায়শই শিশুর চেয়ে বেশি প্রতিযোগিতামূলক। হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং – যা অত্যধিক হস্তক্ষেপের জন্য পরিচিত – শিশুর খেলার আনন্দ কমিয়ে দেয়। চাপের কারণে শিশুর আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদা হ্রাস পায়, এবং অনেক সময় তারা খেলাধুলা ত্যাগ করে।

গবেষণা দেখিয়েছে, “super champion” শিশুরা স্বাধীনভাবে খেলার অভ্যাস রাখে, কারণ তাদের অভিভাবক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন, নির্দেশ দেন না। অন্যদিকে, “almosts” শিশুর অভিভাবকরা অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এবং সবকিছু নিজের হাতেই করতে চান, যা শিশুর স্বাধীনতা কমায়।
শিশুরা তখনই সর্বোত্তমভাবে খেলতে পারে এবং খেলাধুলার আনন্দ উপভোগ করতে পারে যখন তারা নিজেদের জন্য খেলছে – শুধুমাত্র অভিভাবকের জন্য নয়।