ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেফালি আখতার মাত্র ২১ বছর বয়সেই মা হয়েছেন। বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পাননি তিনি। সন্তান আসার খবরে আনন্দ যেমন ছিল, তেমনি ভেতরে ভেতরে ছিল ভয় আর দুশ্চিন্তা।
শুরু থেকেই তিনি ঠিক করে ফেলেন—সন্তান জন্ম দেবেন সিজারিয়ানে। নিয়মিত ডাক্তার দেখানো আর পরিবারের সমর্থন পেয়ে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন।
শেফালির ভাষায়, “আমি জানি স্বাভাবিক প্রসবই ভালো। কিন্তু যদি কোনো ঝুঁকি হতো? আমি আমার সন্তানের জন্য কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। যখন বিকল্প আছে, তখন কষ্টের পথে যাব কেন?”
শেফালির সিদ্ধান্ত ছিল নিজের পছন্দের ফল। কিন্তু ২৮ বছর বয়সী ইতি চৌধুরীর জীবনে সিজারিয়ান ছিল না কোনো পরিকল্পনা—ছিল একান্ত প্রয়োজন।
প্রয়োজন আর পছন্দের মাঝখানে ইতি
করোনার ভয়াবহ সময়ে গর্ভকাল পার করেন ইতি। প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে হঠাৎ পানি ভেঙে যায়, শুরু হয় তীব্র ব্যথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নেন—অপারেশন ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ইতি বলেন, “আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি স্বাভাবিক প্রসবের জন্য। কিন্তু যখন ব্যথা সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন আর কিছু করার ছিল না।”
অপারেশনের পর শুরু হয় আরেক লড়াই। দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণে থাকা, সংক্রমণ, ওষুধ-ইনজেকশন—সব মিলিয়ে প্রায় দেড় মাস কেটেছে শারীরিক জটিলতায়। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই অভিজ্ঞতার ছাপ এখনো রয়ে গেছে তাঁর শরীর ও মনে।
“এখনো পিঠে ব্যথা থাকে। বেশিক্ষণ বসতে পারি না। সন্তান জন্মের পর টানা দুই বছরের বেশি সময় ডিপ্রেশনে ভুগেছি,”—বলতে গিয়ে থেমে যান ইতি।
বাংলাদেশে সিজারিয়ান এখন নিয়ম হয়ে যাচ্ছে?
ইতি ও শেফালির গল্প দুটি আলাদা হলেও বাস্তবতা এক—বাংলাদেশে সিজারিয়ান প্রসব দ্রুত বাড়ছে। ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মিকস ২০২৫ জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন মোট প্রসবের ৫১ দশমিক ৮ শতাংশই হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।
অর্থাৎ, সাম্প্রতিক সময়ে জন্ম নেওয়া প্রতি দুই শিশুর একজনই পৃথিবীতে আসছে সিজারিয়ানে।
সময়ভেদে এই বৃদ্ধির গতি আরও স্পষ্ট—
-
২০১২–১৩ সালে সিজারিয়ান ছিল ১৯ শতাংশ
-
২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশ
-
২০২৫ সালে এসে তা ছাড়িয়ে যায় ৫১ শতাংশ
মিকস প্রতিবেদনে এই প্রবণতাকে সরাসরি ‘উদ্বেগজনক’ বলা হয়েছে।
ধনী-গরিব, শহর-গ্রামে ভিন্ন বাস্তবতা
সিজারিয়ান প্রসবের হার সবার জন্য এক নয়। শহরে এই হার ৫৬ শতাংশ, গ্রামে ৫০ শতাংশ। অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্য এখানে আরও স্পষ্ট।
সবচেয়ে ধনী পরিবারের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী সন্তান জন্ম দেন সিজারিয়ানে। অন্যদিকে সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারে এই হার ৩৪ শতাংশ।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। উচ্চশিক্ষিত নারীদের মধ্যে চারজনের তিনজনই সিজারিয়ানে সন্তান জন্ম দেন, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই—এমন নারীদের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশেরও কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বহুবার বলেছে—চিকিৎসাগত প্রয়োজন ছাড়া সিজারিয়ান করা উচিত নয়। সংস্থাটির মতে, একটি দেশের জন্য ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সিজারিয়ান হারই সবচেয়ে উপযোগী।
নূরা হেলথের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. আরেফিন ইসলাম বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ‘গভীরভাবে উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সিজারিয়ানের হার ডব্লিউএইচওর মানদণ্ডের তিন গুণেরও বেশি। এর পেছনে বড় কাঠামোগত সমস্যা আছে।”
তার অভিজ্ঞতায়, বেশিরভাগ অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। কারণ সেখানে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান দ্রুত শেষ করা যায় এবং আর্থিক লাভও বেশি।
“স্বাভাবিক প্রসবে সময়, পর্যবেক্ষণ আর ধৈর্য লাগে। কিন্তু অপারেশন করলে সব দ্রুত শেষ হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসাগত কারণ না থাকলেও মায়েদের অপারেশনের পথে ঠেলে দেওয়া হয়,”—বলেছেন তিনি।
সিজারিয়ানের প্রভাব শুধু একদিনের নয়
মা ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মঞ্জুর-এ-মাওলা বলেন, সিজারিয়ান একদিনের সিদ্ধান্ত নয়, এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।
“একবার সিজারিয়ানে সন্তান জন্ম দিলে পরবর্তী সন্তান স্বাভাবিকভাবে জন্ম দেওয়ার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে কমে যায়। এটি মায়েদের জন্য বড় বাস্তবতা।”
তিনি আরও বলেন, অনেক নারীই জানেন না কখন সিজারিয়ান জরুরি আর কখন স্বাভাবিক প্রসবই নিরাপদ। আবার কেউ কেউ শুধু প্রসববেদনার ভয়েই শুরু থেকেই অপারেশন চান।
শিশুর ওপরও পড়ছে প্রভাব
মিকস ২০২৫ জরিপে দেখা গেছে, সিজারিয়ানে জন্ম নেওয়া শিশুরা জন্মের পরপরই গুরুত্বপূর্ণ যত্ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অস্ত্রোপচারে জন্ম নেওয়া মাত্র ১৮ শতাংশ শিশুকে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয়েছে। স্বাভাবিক প্রসবে এই হার ৪৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি নবজাতকের স্বাস্থ্য ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
সামনে কী করা দরকার?
জরিপটি বলছে, এখনই স্পষ্টভাবে জানতে হবে—কে, কোথায়, কেন সিজারিয়ান করছেন। অপ্রয়োজনীয় অপারেশন কমাতে প্রসূতি সেবায় কঠোর নজরদারি, মানসম্মত চিকিৎসা ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—মা ও পরিবারকে সচেতন করা। কারণ সিজারিয়ান কখনো জীবন বাঁচায়, আবার কখনো অপ্রয়োজনীয় হলে সারা জীবনের বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

