দেশের বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের দাবি সময়মতো শোধ করতে ব্যর্থ হলেও খরচের ক্ষেত্রে খরচী হওয়ার কোনো দ্বিধা রাখে না। ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সীমা নির্ধারণ করলেও তা মানছে না অনেক কোম্পানি। ২০২৪ সালে ৪২টি বিমা কোম্পানি অনুমোদিত সীমার চেয়ে ৮৩৩ কোটি টাকা বেশি খরচ করেছে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বড় অংশ লোপাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জীবনবিমা কোম্পানি ২০টি ১৫৯ কোটি টাকা এবং ২২টি সাধারণ বিমা কোম্পানি ৬৭৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে। এই খরচের মধ্যে কমিশন, উন্নয়ন সভা, বাড়িভাড়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন, বিজ্ঞাপন, কর্মকর্তাদের দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, গাড়ি ক্রয় ও মেরামত, জ্বালানি, আপ্যায়ন ও ড্রাইভার খরচ অন্তর্ভুক্ত।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির পর্ষদ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মিলেমিশে এই অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে প্রিমিয়ামের অর্থ লোপাট করে। বেশ কয়েকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও অতিরিক্ত খরচ স্বীকার করেছেন। তবে তারা দাবি করেন, কিছু খরচ প্রয়োজনের তাগিদে বেশি হয়েছে, লোপাট নয়।
জীবনবিমা কোম্পানির মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেড শীর্ষে। ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনায় ৪৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে। কোম্পানির সিইও কামরুল হাসান বলেন, “আমি সম্প্রতি যোগ দিয়েছি, তবে শুনেছি এখানে আগে অনিয়ম হয়েছে।”
দ্বিতীয় স্থানে সরকারি জীবন বীমা কর্পোরেশন রয়েছে, ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ দেখিয়েছে। এছাড়া নতুন প্রজন্মের কোম্পানি সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স ১৫ কোটি ৭৫৫ লাখ, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ১১ কোটি ৪২ লাখ এবং সানলাইফ ইনস্যুরেন্স ৯ কোটি ৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।
সাধারণ বিমা কোম্পানির মধ্যে গ্লোবাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড শীর্ষে। ২০২৪ সালে তারা অনুমোদিত সীমার ১১৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা বেশি খরচ করেছে। সিইও জামিরুল ইসলাম বলেন, “আমরা সরকার নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি খরচ করেছি। দেখানো খরচ সঠিক। কমানো সম্ভব নয়।” নন-লাইফ কোম্পানির মধ্যে মার্কেন্টাইল ইসলামী ইনস্যুরেন্স ৯৩ কোটি ৮ লাখ, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ইনস্যুরেন্স ৯১ কোটি ৫৩ লাখ, ইসলামী কমার্শিয়াল ইনস্যুরেন্স ৬৩ কোটি ৬৯ লাখ, দেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স ৪৩ কোটি ১ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।
চট্টগ্রাম চার্টার্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সের সাবেক সিইও ও বিমা বিশেষজ্ঞ এস এম জিয়াউল হক বলেন, “ম্যানেজমেন্টের অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার কারণে কোম্পানিতে এই অনিয়ম হচ্ছে।” অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাকও সতর্ক করে বলেন, “কোম্পানিগুলোতে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। নয়তো নিজের স্বার্থেই খাতের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের সিইও সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান বলেন, “নিয়মিত অডিট থাকলে এই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতো না।”
বিমা আইন ২০১০ এবং বিধিমালা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩৬টি জীবনবিমা কোম্পানি সর্বোচ্চ ৩,৭৯৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারত। অথচ তারা খরচ করেছে ৩,৮৫২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৫২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেশি। একই সময়ে ১৬ কোম্পানি খরচ কমিয়েছে, এর মধ্যে ন্যাশনাল লাইফ একাই ৯০ কোটি টাকা কম খরচ করেছে।
জীবনবিমার মধ্যে হোমল্যান্ড লাইফ ৮ কোটি ১২ লাখ, চার্টার্ড লাইফ ৬ কোটি ৮৭ লাখ, সানফ্লাওয়ার লাইফ ৬ কোটি ১১ লাখ, পদ্মা ইসলামী লাইফ ৫ কোটি ৫৯ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ৪ কোটি ৩৮ লাখ, জেনিথ ৪ কোটি ৩৩ লাখ, যমুনা লাইফ ৪ কোটি ২ লাখ, সান্তা লাইফ ৩ কোটি ৭০ লাখ, ডায়মন্ড লাইফ ৩ কোটি ২৬ লাখ, মেঘনা লাইফ ৩ কোটি ২৫ লাখ, স্বদেশ লাইফ ২ কোটি ৬৫ লাখ, লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অব বাংলাদেশ ২ কোটি ২০ লাখ, বায়রা লাইফ ১ কোটি ১৫ লাখ, বেস্ট লাইফ ১ কোটি ৯ লাখ এবং ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ১ লাখ টাকা অনুমোদনহীন খরচ করেছে।
২০২৪ সালে ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ১,৫৭৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। তারা খরচ করেছে ১,৩১১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে ২৬৫ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। তবে ২২টি কোম্পানি অতিরিক্ত খরচের মাধ্যমে লুটপাট করেছে। এই তালিকায় গ্লোবাল ইনস্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইসলামী, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ, ইসলামী কমার্শিয়াল ও দেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স অন্যতম। বিমা মালিক ও সিইওদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক এ এস এম নূরুজ্জামান বলেন, “বিমা কোম্পানিকে দাবি পূরণে মনোযোগ দিতে হবে। খরচ কমালে ব্যবসা বাড়বে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম জাহীদ বলেন, “খাতের তিনটি বড় সংকট দেখা দিয়েছে—নৈতিক বিপত্তি, তথ্যের ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা। আইডিআরএর কড়া নজরদারি জরুরি।” আইডিআরএর মিডিয়া ও যোগাযোগ পরামর্শক সাইফুন্নাহার সুমি জানান, “নিয়ম ভঙ্গের জন্য ২০২৩ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে জরিমানা করা হয়েছে। ২০২৪-এ যারা আইন লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

