গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ‘পপুলার রেসিং’ বা গণঅভ্যুত্থানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বীমা দাবি পরিশোধযোগ্য নয়—এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বীমা সংস্থাগুলো। স্ট্যান্ডার্ড ফায়ার পলিসি (এসএফপি) বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অল রিস্কস (আইএআর) পলিসির আওতায় আরঅ্যান্ডএসডি কভারেজ থাকা সত্ত্বেও এ দাবি অগ্রাহ্য করা হবে বলে গত ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
তবে দাবি নিষ্পত্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো শিল্পমালিক, বাণিজ্যিক সংগঠন বা ক্ষতিগ্রস্ত বীমাগ্রহীতার প্রতিনিধি আলোচনায় ছিলেন না। এই একতরফা সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে শিল্প ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো দ্রুত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান বরাবর গত ১৫ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে সিদ্ধান্তটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দুষ্কৃতিকারীরা হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালায়। এসব হামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে মূলত লুটতরাজ ও ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিল।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আন্দোলনকারীদের লক্ষ্যবস্তু ছিল না। বরং অরাজক পরিস্থিতির সুযোগে সংঘবদ্ধ চক্র নাশকতা চালিয়ে বিপুল ক্ষতি করে। কিন্তু সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সভায় বিদেশি পুনঃবীমাকারীদের উদ্ধৃতি দিয়ে সব ক্ষতিকেই “গণঅভ্যুত্থান” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানার বীমা দাবি পরিশোধের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
বিটিএমএ সভাপতি চিঠিতে বলেন, এত বড় অঙ্কের ক্ষতি যদি বীমার আওতায় না আসে, তাহলে অনেক শিল্পকারখানাই আর চালু করা সম্ভব হবে না। এতে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বাড়বে, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতাও ঝুঁকিতে পড়বে।
বিটিএমএর চিঠিতে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি ন্যায্যতার নীতি লঙ্ঘন করেছে। বীমা চুক্তিতে দুটি পক্ষ—বীমাকারী ও বীমাগ্রহীতা—থাকলেও ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ আলোচনায় ছিলেন না। এটি প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতি ‘Audi Alteram Partem’ (অপর পক্ষের বক্তব্য শোনা)-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী, আইনানুগ প্রক্রিয়া ছাড়া কারও সম্পত্তির ক্ষতি করা যাবে না। বীমা দাবির অর্থপ্রাপ্তি একটি বৈধ চুক্তিভিত্তিক অধিকার। তাই কোনো শুনানি ছাড়াই দাবি বাতিল করা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে সর্বোচ্চ আদালতের কয়েকটি নজিরও তুলে ধরা হয়—যেমন আব্দুল লতিফ মির্জা বনাম বাংলাদেশ সরকার (৩১ ডিএলআর) এবং মাহিনুদ্দিন বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৪৫ ডিএলআর) মামলায় আদালত বলেছেন, “কোনো ব্যক্তিকে না শুনে ক্ষতির দায়ভার চাপানো ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।”
বিটিএমএ আরও বলেছে, ১৬ জুলাই থেকে পরবর্তী সব ঘটনাকে ‘পপুলার রেসিং’ হিসেবে ঘোষণা করা বাস্তবতার সরলীকরণ। বেশিরভাগ ঘটনাই দাঙ্গা, লুটতরাজ বা অগ্নিসংযোগের অন্তর্ভুক্ত—যা আরঅ্যান্ডএসডি কভারেজের মধ্যেই পড়ে। তাই আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবি নিষ্পত্তি করা উচিত।
আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ক্ষতিপূরণ প্রদানের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন—থাইল্যান্ডে ২০১০ সালের দাঙ্গা, লন্ডনে ২০১১ সালের দাঙ্গা বা যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা রাজ্যে ২০২০ সালের সহিংসতার পর বীমা কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এমনকি যুক্তরাজ্যের “দাঙ্গা ক্ষতিপূরণ আইন ২০১৬”-এর অধীনেও সরকার ও বীমা কোম্পানিগুলো যৌথভাবে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।
বিটিএমএ মনে করে, একইভাবে বাংলাদেশেও একটি জাতীয় ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করা যেতে পারে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত আর্থিক সহায়তা পায়।
সংগঠনটির ভাষায়, “বীমার মূল উদ্দেশ্যই হলো বিপদের দিনে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করা। আইন ও নীতির সংকীর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে যদি সব দাবি বাতিল করা হয়, তবে শিল্পমালিকরা দেউলিয়া হবে, আর দেশের বীমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে।”
তাদের দাবি—বীমা আইন, ২০১০ অনুসারে ৯০ দিনের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তির স্পষ্ট প্রক্রিয়া নির্ধারণ ও ন্যায্য সমাধান নিশ্চিত করতে আইডিআরএর চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ জরুরি।

