একীভূত হতে যাওয়া একটি ব্যাংকে আজবাহার শেখের (ছদ্মনাম) ৯ লাখ টাকার আমানত রয়েছে, কিন্তু নানা চেষ্টা করেও তিনি পুরো টাকা তুলতে পারছেন না। শাখা ব্যবস্থাপকের পরামর্শে তিনি টাকাটি ভেঙে পাঁচজনের নামে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে নতুন পাঁচটি সঞ্চয় হিসাব খুলেছেন। এতে এখন তাঁর ৫টি হিসাব হয়েছে। ফলে আমানত বীমা সুরক্ষা তহবিল থেকে পুরো ৯ লাখ টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় আছেন তিনি। কারণ একক নামে থাকলে বীমা সুবিধায় সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ফেরত পাওয়া যেত।
জানা গেছে, একীভূত হতে যাওয়া এক্সিম, সোস্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের আমানতকারীরা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বীমা সুরক্ষা পাবেন। এই সুবিধা নিতেই অনেক গ্রাহক একাধিক নামে ছোট ছোট হিসাব খুলছেন। ফলে হিসাবের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
এই তথ্য জানার পর গত রোববার সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ডেকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ (মঙ্গলবার) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকটি টিম এসব ব্যাংক পরিদর্শনে নামছে। তারা খতিয়ে দেখবে, শাখা কর্মকর্তারা কারা এই খণ্ডিতকরণে জড়িত এবং এটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে করা হচ্ছে কিনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত কমছে, কিন্তু হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে মোট আমানত কমে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে—যা জুন শেষে ছিল এক লাখ ৪৬ হাজার কোটি। অথচ হিসাবের সংখ্যা বেড়ে ৭৫ লাখ ছাড়িয়েছে, যা কয়েক মাস আগেও ৭০ লাখের নিচে ছিল।
অমানত কমার একটি কারণ হলো, এসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া বিশেষ ঋণ পরিশোধ করছে। আবার খেলাপি ঋণ থেকে আদায়কৃত অর্থের কিছু অংশ ফেরত দেওয়া হচ্ছে আমানতকারীদের। অন্যদিকে বড় অঙ্কের আমানত ভেঙে একাধিক নামে রাখায় হিসাবের সংখ্যা আরও বেড়েছে। একটি ব্যাংকে একাই সর্বোচ্চ ১১ লাখ নতুন হিসাব যুক্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
চলতি বছরের মে মাস থেকে পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনা শুরু হয়। এরপর গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আমানতকারীদের বীমা তহবিল থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ফেরতের আশ্বাস দেন। গত ৫ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদে এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ অনুমোদন হয়। এর আগে বীমা ট্রাস্ট তহবিল থেকে কেবল কোনো ব্যাংক বন্ধ হলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেওয়ার নিয়ম ছিল। নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে এখন পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারীরা প্রথম ধাপে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “এভাবে নতুন হিসাব খুলে বীমা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতেই সরকার এই তহবিল গঠন করেছে। কেউ কৌশল করে সুবিধা নিতে পারবে না। প্রশাসকরা প্রতিটি হিসাব ভালোভাবে যাচাই করবেন।”
সরকার শরিয়াহভিত্তিক সমস্যাগ্রস্ত পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে একটি বড় ইসলামী ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই ব্যাংকের প্রাথমিক মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২০ হাজার কোটি এবং প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার দেওয়া হবে। প্রশাসকরা দায়িত্ব নেওয়ার ১৭ দিনের মধ্যে বীমা তহবিল থেকে আমানতকারীদের সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হবে। এতে ১২ হাজার কোটি টাকার পরিশোধে প্রায় ৯৩ শতাংশ আমানতকারীর দায় শোধ হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে এই অর্থ দেওয়া হবে। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে বাকি টাকা তোলা যাবে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, “হঠাৎ হিসাব বাড়ার বিষয়টি সন্দেহজনক, তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদন্ত করাই স্বাভাবিক। কেউ কেউ অনিশ্চয়তা থেকে সন্তানের নামে টাকা স্থানান্তর করেছেন—তা স্বাভাবিক। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে একাধিক নামে হিসাব খোলা হলে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, অনেক ব্যক্তিগত আমানতকারী শাখা কর্মকর্তাদের আত্মীয় বা পরিচিত। তাদের পরামর্শে কেউ কেউ টাকাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করছেন। আবার কিছু ব্যাংককে টিকিয়ে রাখতে প্রধান কার্যালয় থেকে আমানত বৃদ্ধি ও ঋণ আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। ফলে কেউ কেউ লক্ষ্য পূরণের দেখাতে এমন কাজও করে থাকতে পারেন। তদন্ত শেষে পুরো চিত্র পরিষ্কার হবে।