জীবন বিমা খাতের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা জীবন বীমা করপোরেশন (জেবিসি) গত রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন পেনশন বিমা পলিসি চালু করেছে। পলিসির নাম ‘জেবিসি পেনশন বিমা’। তবে এই পলিসি চালুর এখতিয়ার জেবিসির আছে কি না—এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
আগে জেবিসির একই ধরনের পেনশন বিমা পলিসি ছিল। ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর সেই পলিসি বন্ধ করা হয়। এখন সেটি নতুন নামে পুনরায় চালু হয়েছে। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) নতুন পলিসির অনুমোদন দিয়েছে। জেবিসি জানিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসী, ব্যবসায়ী, ঠিকাদারসহ যে কোনো বাংলাদেশি নাগরিকই নতুন পেনশন বিমার গ্রাহক হতে পারবেন।
২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার চার ধরনের স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করে। স্কিমগুলো হলো—প্রগতি, প্রবাস, সুরক্ষা ও সমতা। দুই বছরে এই চারটি স্কিমে ২১৩ কোটি টাকা চাঁদা জমা পড়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম কিছুটা ধীরগতি পায়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কর্মসূচির গুরুত্ব বোঝে এবং নতুন উদ্যোগ নেয়। ২৬ অক্টোবর খুলনায় পেনশন মেলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলা উদ্বোধন করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশিদ। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এক বছরে কয়েকবার সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই কর্মসূচি দেশে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সরকার যখন সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার কার্যক্রম আরও প্রসারিত করতে চায়, তখন দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় বিমা সংস্থা জেবিসি নতুন করে পেনশন বিমা চালু করেছে। এতে জেবিসির উদ্যোগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রধানত এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন। জেবিসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন। অন্যদিকে সর্বজনীন পেনশন পরিচালনা করছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। এর চেয়ারম্যান অর্থ উপদেষ্টা। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ও শ্রম সচিব।
জেবিসির চেয়ারম্যান মো. মোখলেস উর রহমান, যিনি জনপ্রশাসন সচিব থাকাকালেই পদে ছিলেন, বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হলেও চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন। জেবিসির পরিচালনা পর্ষদে বিমা খাতের বিশেষজ্ঞ নেই। অধিকাংশ সদস্যই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম বা অতিরিক্ত সচিব। পর্ষদে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষক, একজন সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ ও বিমা একাডেমির পরিচালক। এই পর্ষদই নতুন পেনশন বিমা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া:
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেছেন, ‘পেনশনের সমান্তরাল স্কিম না থাকাই যৌক্তিক। জেবিসির পলিসি আমাদের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, আমরা যাচাই করব।’ নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দীন খান বলেন, ‘জেবিসি “পেনশন” শব্দ ব্যবহার করে পলিসি তৈরি করতে পারে না। কেন এমন করা হয়েছে, তা আমি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের সঙ্গে আলোচনা করব।’ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেছেন, ‘জেবিসির পর্ষদই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি খোঁজ নেব।’
জেবিসি ও আইডিআরএর ব্যাখ্যা:
জেবিসির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোনে পাওয়া যায়নি। বার্তা পাঠানো হলেও জবাব মেলেনি। জেবিসির মহাব্যবস্থাপক (উন্নয়ন) মাজেদুল ইসলাম সরকার বলেছেন, ‘আগের পলিসি বন্ধ থাকলেও আমরা গবেষণা করেছি। আইডিআরএর অনুমোদন নিয়ে নতুন পলিসি চালু করা হয়েছে।’ আইডিআরএর সদস্য (লাইফ) আপেল মাহমুদ বলেছেন, ‘জেবিসি এটি করতে পারে।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ ১৩-১৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণ করেন। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, দেশে ফিরে তিনি জেবিসির নতুন পেনশন বিমা ও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের স্কিমের মধ্যে সমন্বয় ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবেন। ২০২১ সালে জেবিসি ‘বঙ্গবন্ধু সর্বজনীন পেনশন বিমা নামে পলিসি চালু করেছিল। এরপর সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করলে একই ধরনের নাম থাকায় দুটি কার্যক্রম পাশাপাশি চলত। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জেবিসি পুরোনো পলিসির নাম পরিবর্তন করে ‘মেয়াদি সুবিধাযুক্ত পেনশন বিমা’ রেখেছে।