জলবায়ু পরিবর্তন আজকের পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যা। এটি মানুষের স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, জল নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ক্রমবর্ধমান গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার এবং পরিবেশগত অব্যবস্থাপনা আমাদের পৃথিবীর জলবায়ুকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৫ সালে প্যারিসে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যার ফলস্বরূপ প্যারিস চুক্তি গৃহীত হয়। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কাঠামো গড়ে তোলা।
মূলত এই চুক্তিটি হলো গ্রীন হাউজ গ্যাস কমানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী চুক্তি। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে গৃহীত প্যারিস চুক্তিটির লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিকারী গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করা । এটি বিভিন্ন দেশকে একটি সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লক্ষ্যে কাজ করতে উৎসাহিত করে।
২০১৫ সালের জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে ১৯৬ টি দেশ প্যারিস চুক্তির আলোচনার অংশ হিসেবে উপস্থিত ছিল। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তনের কনভেনশনের ১৯৫ সদস্য দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
প্যারিস চুক্তির গুরুত্ব ও লক্ষ্য-
প্যারিস চুক্তির মূল লক্ষ্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প বিপ্লবের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখা। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবেলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।
প্যারিস চুক্তি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। উন্নত দেশগুলো যেহেতু বেশি কার্বন ও অন্যান্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিকারী গ্যাস নিঃসরণ করে কিন্তু তার কুফল ভোগ করতে হয় উন্নয়নশীল সহ অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলোকেই। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য চুক্তিতে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করবে যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোও টেকসই উন্নয়নের পথে চলতে পারে। এঘাবড়ে প্যারিস চুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করার মাধ্যমে জলবায়ু অভিযোজন এবং নিরসন কার্যক্রমকে গতিশীল করা হয়, যা বিশ্বের বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষা করে।
প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশগুলোকে তাদের গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। চুক্তিটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যেখানে প্রতিটি দেশের নিজস্ব অবদান এবং প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এই হিসেবে বলা যায়, চুক্তির গুরুত্ব অনেক গভীর। যা কেবল আন্তর্জাতিকভাবে এর সদস্য দেশগুলো নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সমাধানের পথ বের করে তা নয় বরং এটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সমতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে প্যারিস চুক্তি দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ভিত্তি স্থাপন করে। এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের প্রতি একটি বার্তা দেয়া হয় যে তাদের একক প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয় বরং একটি সমন্বিত ও যৌথ উদ্যোগই জলবায়ু সংকট মোকাবেলার জন্য আবশ্যক।
প্যারিস চুক্তি শুধু একটি কৌশলগত পরিকল্পনা নয় বরং একটি বৈশ্বিক আহবান, যেখানে সব দেশ সম্মিলিতভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো ছাড়াও, এ চুক্তি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, কার্বন নিরপেক্ষ প্রযুক্তি গ্রহণ এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দেয়।অনুন্নত দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা
প্যারিস চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান। চুক্তির অংশ হিসেবে উন্নত দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অভিযোজন এবং নিরসনে সহায়ক হবে। কারণ অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষম হবে না।
বাংলাদেশ ও ক্লাইমেট ফান্ড
বাংলাদেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে কিছু তহবিল পেয়েছে। যেমন বাংলাদেশ গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে বড় পরিমাণে অর্থ পেয়েছে, যা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং অভিযোজন প্রকল্পে ব্যবহৃত হবে। ২০২২ সাল থেকে মোট ৩৪০মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ পেয়েছে। বর্তমানে জিপিএফ বা গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডের তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু প্রকল্প বাংলাদেশে চলমান রয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও তহবিল পায়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়। যার পরিমাণ প্রায় কয়েকশো মিলিয়ন ডলার।
কিছু উন্নত দেশ যেমন জাপান এবং সুইডেন ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষ তহবিল প্রদান করেছে যা অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত হয়। দ্বিপাক্ষিক সহায়তা হিসেবে বাংলাদেশ প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে পেয়েছে।কোপ২৭ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলবায়ু তহবিলের চাহিদা এবং উদ্যোগগুলোকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরা হয়, যেখানে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তহবিল এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। বাংলাদেশের জন্য বিশেষ করে বন্যা, সাইক্লোন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই তহবিলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোর কার্যকলাপের ফলে যে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেসব দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, কেনিয়া, ফিলিপাইন, উগান্ডা,
মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, তানজানিয়া ইত্যাদি।
গ্লোবাল স্টকটেক: অগ্রগতির মূল্যায়ন
প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আওতায় বৈশ্বিক স্টক টেক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার আওতায় প্রতি পাঁচ বছরে সদস্য দেশগুলো তাদের জলবায়ু পরিকল্পনার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে। এই পর্যালোচনায় সদস্য দেশগুলো তাদের নির্ধারিত লক্ষ্য এবং উদ্যোগগুলো কতটা কার্যকর হয়েছে তা উপস্থাপন করে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রতিটি দেশের অবদান স্পষ্ট হয়। এই প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, যা জলবায়ু কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করে। সদস্য দেশগুলো তাদের অভিজ্ঞতা এবং উন্নয়ন অন্য দেশগুলোর কাছে ভাগাভাগি করে, যা সকলের জন্য উপকারে আসে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা। এই স্টক টেকসই উন্নয়নের প্রক্রিয়া প্রত্যেক দেশের জন্য জলবায়ু পরিকল্পনা এবং অভিযোজনের ক্ষেত্রে নতুন দিশা নির্দেশ করে। তাছাড়া এটি জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় একটি কার্যকর পরিকল্পনা হিসেবে কাজ করে। ফলে বৈশ্বিক স্টক টেকসই উন্নয়ন জলবায়ু পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য।
চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবায়নে বাধা যদিও প্যারিস চুক্তি একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ তবে এর বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, অনেক দেশ রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবে তাদের প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারছে না। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো পর্যাপ্ত সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট সদিচ্ছার অভাবে এখনও তাদের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সহায়তা সব সময় যথাসময়ে পাওয়া যায় না, যা তাদের জলবায়ু অভিযোজন এবং নিরসন প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। এছাড়া, বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী তাদের প্রতিশ্রুতির মানদণ্ডও পরিবর্তনশীল।
প্যারিস চুক্তির সাফল্যের জন্য জনগণের সচেতনতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। চুক্তির মূল লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য সরকার, এনজিও এবং অন্যান্য সংস্থার কাজ করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি তাদের সম্পৃক্ত করতে পারলে একটি টেকসই উন্নয়ন কাঠামো তৈরি করা সম্ভব।
বস্তুত প্যারিস চুক্তি একটি বৈশ্বিক চুক্তি যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপের একটি প্রতীক। এ চুক্তির লক্ষ্য এবং গুরুত্ব বহুমাত্রিক—এটি বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পথও প্রশস্ত করে। যদিও এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে প্যারিস চুক্তি-২০১৫ বিশ্বব্যাপী একটি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই ভবিষ্যত নির্মাণের পথ নির্দেশ করে। এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জনগণের অংশগ্রহণের উপর, যা একসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব মোকাবেলায় একটি কার্যকরী সমাধান দিতে পারে।