বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাশিয়া- ইউক্রেন সংঘাত একটি বহুল আলোচিত বিষয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রীতি- নীতি। সামরিক কৌশলগুলো দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে। এই সংঘাত শুধু ইউরোপের নিরাপত্তা সঙ্কটই নয়। বরং পুরো বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ করেছে। ন্যাটো-যারা ঐতিহাসিকভাবে একটি পশ্চিমা সামরিক জোট হিসেবে পরিচিত। এই নতুন পরিস্থিতিতে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। যার মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতির গতি ও দিকনির্দেশনা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
মূলত রাশিয়া- ইউক্রেন সংঘাত ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রিমিয়া অঞ্চলের রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এর মাধ্যমে শুরু হয়। এই আগ্রাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় সংঘাত। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ২০২২ সালে ইউরোপের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে নতুনভাবে পরিবর্তন করে দেয়। ইউক্রেনের দিকে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন এবং ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া এই সংকটকে শুধু ইউরোপীয় রাজনীতির জন্য নয়। বরং বৈশ্বিক রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য মোড় হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে ন্যাটোর ভূমিকায় বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন মাত্রা এবং শক্তির মেরুকরণ শুরু হয়েছে। এই সংঘাতে কেবল দুই দেশের সম্পর্ক প্রভাবিত হয়নি । বরং এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক আইন এবং শক্তির ভারসাম্যেও এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
রাশিয়া- ইউক্রেন সংঘাতের পটভূমি:
সংঘাতের সূত্রপাত হয় ২০১৪ সালে। এ যুদ্ধে এ পর্যন্ত শত শত লোককে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার সামরিক এবং বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে। ২০২৪ সালের হিসেবে রাশিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেনে প্রায় ২০% দখল করেছে । যার মধ্যে ২০১৪ সালের মার্চে দখল করা ক্রিমিয়ার বিরাট অংশ রয়েছে। ইতোমধ্যেই তারা ইউক্রেনের ডনবাস, মারিওপোল, ডনেটস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিজ্জিয়া, খেরসন অঞ্চলের কিছু অংশ দখলে নিয়েছে ।
রাশিয়া ইউক্রেনের প্রথমে ক্রিমিয়া ও অন্যান্য উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। পরবর্তীতে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে একত্রীকরণের ঘোষণা দেয় । এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন বিশেষ করে জাতিসংঘের চার্টার এবং হেলসিংকি চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়। এর পরপরই ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে বিচ্ছিন্নবাদী গোষ্ঠী এবং রাশিয়ার মদদে একটি সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। যা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের প্রচেষ্টা এবং পশ্চিমা সামরিক সাহায্য রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে ত্বরান্বিত করেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সহসাই যুদ্ধ থামবে এমন কোন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। না ইউক্রেন না রাশিয়া, না তাদের কোন মিত্র , কারো পক্ষ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন চিহ্ন নেই।
ন্যাটোর সম্প্রসারণ:
২০২২ সালে এসে দেখা যায়, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে ন্যাটোর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। এর পেছনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একটি বড় ভূমিকা আছে। বর্তমানে ৩০টি দেশ এই জোটের সদস্য। বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। ২০২০ সালে এই জোটে যোগ দেয়া সর্বশেষ সদস্য উত্তর মেসিডোনিয়া।
এ জোটের সদস্য দেশ হওয়ার প্রধান ও অন্যতম শর্ত যেকোনো সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণকে সব মিত্রদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। যার ফলে একে অপরকে সুরক্ষিত রাখতে সদস্য রাষ্ট্ররা দায়বদ্ধ।
১৯৯১ সাল থেকে ন্যাটোর সদস্যপদে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো যোগদান করেছে। যা রাশিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা রাশিয়ার দৃষ্টিতে সরাসরি হুমকি। এই প্রসঙ্গে রাশিয়া-ন্যাটো সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং সংঘাতের সূত্রপাত হয়।
২০২২ সালে ইউক্রেনে মস্কোর পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক কৃষ্ণ সাগরের তার দুই প্রতিবেশী রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধের যেসব ক্ষেত্রে ন্যাটোর ভূমিকা রয়েছে সেগুলো হলো- ন্যাটো ইউক্রেনকে সরাসরি সামরিক সহায়তা না দিলেও সদস্য দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, কৌশলগত সাহায্য এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছে। ন্যাটোর এই সহায়তা প্রমাণ করে যে ন্যাটো পরোক্ষভাবে এই সংঘাতে জড়িত। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যা রাশিয়ার অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে।
ন্যাটো ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সংহতির কারণে ন্যাটো সদস্যরা ইউক্রেনকে সমর্থন এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। যা রাশিয়ার আঞ্চলিক প্রভাব এবং ক্ষমতার ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। ন্যাটোর সদস্যরা নিজেদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছে এবং সামরিক আধুনিকীকরণে মনোনিবেশ করছে। যা রাশিয়ার আক্রমণাত্মক অবস্থানের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ফলে বিশ্বে একটি নতুন মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে, যা বিশ্বকে দ্বিমেরুকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একদিকে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে ন্যাটো জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে চীন , ইরান এবং ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলো রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে।
ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়াকে নতুন মিত্র এবং বাণিজ্য অংশীদার খুঁজতে বাধ্য করেছে। যার ফলে বিশ্ব বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
চীন এবং রাশিয়া একে অপরের সাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সময় চীন রাশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চীনের এই অবস্থান বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে চীনের উত্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী মেরু তৈরি করতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ফলে ইউরোপের জ্বালানি পরিস্থিতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার তেল এবং গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এই সংঘাত এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপ বিকল্প জ্বালানি উৎসের সন্ধান করছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাজারে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে।
ন্যাটোর পুনরুত্থান:
শীতল যুদ্ধের পর ন্যাটোর প্রাসঙ্গিকতা অনেকটাই কমে গেলেও বাস্তবতার সাপেক্ষে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ন্যাটোকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। অনেক দেশ ন্যাটোতে যোগদানের চেষ্টা করছে এবং ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের মতো দেশগুলো অন্য দেশের আক্রমণ থেকে নিজের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটোতে যোগদান করছে ,যা রাশিয়ার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া অনেক আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছে। একই সঙ্গে ইউক্রেনের কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায় খাদ্য নিরাপত্তা সংকট দেখা দিয়েছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে।
এই যুদ্ধের ফলে নতুন করে আলোচনায় আসা ন্যাটোর ভূমিকা শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যেও নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইরান, সিরিয়া এবং অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। রাশিয়া- ইউক্রেন সংঘাতের পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও নিজেদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে।
সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক মেরুকরণ, ন্যাটোর পুনর্জাগরণ এবং রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কের গভীরতা নতুন ধরনের বৈশ্বিক ভারসাম্য তৈরি করছে। এই সংকটের ফলে ন্যাটোর প্রাসঙ্গিকতা আবার সামনে এসেছে এবং এটি বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ফলে বলা যায়, বিশ্ব এখন এক নতুন শক্তি সংঘাতের মধ্যে প্রবেশ করেছে, যা আগামী দিনে বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে।