ইসরায়েলি পণ্য বর্জন শুধু রাজনৈতিক কোনো অবস্থান নয়। এটি ইসলাম, মুসলিম উম্মাহ এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। আমরা সরাসরি কিছু করতে না পারলেও অন্তর থেকে দোয়া করতে পারি। পাশাপাশি ইসরায়েল বা তাদের সহযোগীদের পণ্য ও প্রতিষ্ঠান বর্জন করতে পারি। এই কাজ আপনি-আমি একা একাও করতে পারি। কারণ, শেষ পর্যন্ত জবাবদিহি করতে হবে নিজেকেই। অন্য কাউকে দায়ী করে দায় এড়ানো যাবে না।
বয়কট কোনো সাময়িক উদ্যোগ নয়। এটি একটি চলমান আন্দোলন। ব্যক্তি পর্যায়ে শুরু করা সম্ভব। কেউ একে থামাতে পারে না। তাই আমাদের সচেতন থাকতে হবে। সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানো উচিত আমাদের দায়িত্ব হিসেবেই।
আমাদের প্রথম কিবলা আজ দখলদারদের হাতে লাঞ্ছিত। বাইরের মুসলিমরা তো দূরের কথা, ফিলিস্তিনিরাও স্বাচ্ছন্দ্যে সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। আল-আকসা মসজিদ, যেখানে রাসুল (সা.) ইমামতি করেছিলেন, সেটিও এখন হামলা ও অবমাননার শিকার। গাজার মানুষ যারা এই পবিত্র স্থানের রক্ষক, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্ব কার্যকর কোনো কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তাই আমাদের অন্তত দোয়া করতে হবে। কুনূতে নাজেলা পড়া দরকার। একদিনের মিছিল বা ফেসবুক পোস্ট দিয়ে দায় শেষ হয় না। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ তাদের সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলছে। তারা পণ্য বর্জন করছে, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে, ফিলিস্তিনের পতাকা ধারণ করছে।
আজ ফিলিস্তিন ধ্বংসের পথে। আল-আকসা মসজিদ আজ আগ্রাসনের মুখে। এই ধ্বংসযজ্ঞের জবাব একদিন দিতে হবে আল্লাহর দরবারে। সেখানে থাকবে না বন্ধু, পরিবার বা অনুসারী কেউই। আমাদের আল্লাহকে ভয় করতে হবে। সময়ের গুরুত্ব বুঝতে হবে। দায়িত্ব এড়ানো যাবে না।
আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড় শক্তি পণ্য। কর্পোরেট শক্তিগুলো পণ্য বিক্রির ওপরই নির্ভরশীল। আর এই পণ্যের প্রধান ক্রেতা আমরা, সাধারণ মানুষ। তাই বয়কট আমাদের হাতের সবচেয়ে বড় প্রতিবাদের অস্ত্র।
যারা আমাদের ঘর ধ্বংস করে, ভাই হত্যা করে, সন্তান কেড়ে নেয়—তাদের পণ্য বর্জন করলেই বোঝানো যায় আমরা অন্যায়ের পক্ষে নই। তবে মনে রাখতে হবে, সব অমুসলিম পণ্য হারাম নয়। যদি তা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়, তবে তা বৈধ। কিন্তু যেসব পণ্য ইসরায়েলের দখলদারিতে সহায়তা করে, সেগুলো হারাম।
বাকি পণ্য বর্জনের ভিত্তি হলো—চেতনার জিহাদ। ইসলামে বয়কট এবং অর্থনৈতিক অবরোধ জিহাদেরই অংশ। রাসুল (সা.)-ও খায়বরে অর্থনৈতিক অবরোধ করেছিলেন। তাই মুসলিম দেশগুলোর উচিত একযোগে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করা।
যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে তা হচ্ছে না, তাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে বয়কট শুরু করা উচিত। এটিই আমাদের আর্থিক জিহাদ। অনেকে বলেন, “আমি একজন করলেই বা কী হবে?”—এই প্রশ্নে ভীত হবার কিছু নেই। একজনের ত্যাগ হয়তো তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনে না কিন্তু অনেকের একত্রিত ত্যাগ বড় প্রভাব ফেলে। ছোট ছোট ত্যাগ একদিন বড় আন্দোলনে পরিণত হয়। আমাদের কাজ শুধু চেষ্টা করা। ফল আল্লাহর হাতে।
প্রশ্ন হওয়া উচিত—“আমি কী করেছি?” শুধু “কতটা ক্ষতি করেছি” এই চিন্তা না করে। পণ্য বয়কট মানে হৃদয়ের প্রতিবাদ। এটি লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়। এটি আত্মার অনুভূতির বিষয়।
হ্যাঁ, এই বয়কট আর্থিকভাবেও কাজ করে। যদি সকলে একযোগে অংশ নেয়, তাহলে বড় পরিবর্তন সম্ভব। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে। ইহুদিরা অর্থনীতিতে শক্তিশালী। তাই তাদের পরিবর্তন আনতেও অর্থনীতিই মূল অস্ত্র।
একজন মানুষ কোকাকোলা বা পেপসি পান করতেন না। একদিন কেউ তাঁকে বলল—”খেলে কিছু হবে না, খান না কেন?” তিনি বললেন—“হয়তো আমার না খাওয়ায় কিছু হবে না। কিন্তু যখনই খেতে যাই, চোখে ভেসে ওঠে ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত শিশুর মুখ। আমি সেই পণ্য কীভাবে মুখে তুলি?” এই কথার পর আর কোনো উত্তর ছিল না।
এটি একান্তই অনুভূতির ব্যাপার। যার চেতনায় ভালোবাসা আছে, তার কাছে পণ্য প্রিয় হতে পারে না। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি কী ব্যবহার করবেন, তা নির্ভর করছে আপনার ঈমান, মানবতা এবং বিবেকের ওপর। যদি আপনি রক্তমাখা স্মৃতি ভুলে পণ্য কেনেন, তবে বলার কিছু নেই।
অনেকে বলেন—“সব দেশের পণ্য বর্জন করলে ব্যবহার করবো কী?”—এই যুক্তি শুনতে ঠিক কিন্তু বাস্তবে ঠিক না। আপনি যতটুকু পারেন ততটুকু করুন। সেটাই যথেষ্ট। পুরোটা পারলে ভালো। না পারলেও যতটুকু পারবেন, ততটুকুই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষে বলি—নিজের অবস্থান স্পষ্ট করুন। আপনি নিপীড়কের পাশে, না নিপীড়িতের পাশে? কারণ একদিন জবাব দিতে হবে। এই নীরবতার, উদাসীনতার, আর অবহেলার হিসাব দিতে হবে আল্লাহর সামনে।