যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর ২৫ জুলাই মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ২০২১ সালে দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তখন বাইডেন প্রশাসন মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছিল।
নতুন এই সিদ্ধান্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিপরীত ধারা বলেই দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত পরাজয় তো বটেই, চীনের জন্য এক বড় কৌশলগত জয়। অনেকে বলছেন, এই পদক্ষেপ ‘মিয়ানমার ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের পিছু হটা যুদ্ধের’ সর্বশেষ অধ্যায়।
এই সময় নির্বাচন করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, কয়েক দিন আগেই মার্কিন কংগ্রেসে তিনটি বিল পাস হয়, যেখানে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয় এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
তবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনো কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এর মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইং ট্রাম্পের প্রকাশ্য প্রশংসা করেন। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও চাটুকারিতার রাজনীতি এতে প্রভাব ফেলেছে।
একই সঙ্গে ট্রাম্পপন্থি ব্যবসায়ী লবিস্টদের একটি অংশ যুক্তি দিচ্ছে—মিয়ানমারে বিরল খনিজ রয়েছে, যা ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রযুক্তিপণ্যে ব্যবহৃত হয়। এসব খনিজ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত সম্পদ হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার এখন বিশ্বের অন্যতম বিরল খনিজ রপ্তানিকারক দেশ। চীন পরিবেশ রক্ষায় নিজ দেশে খনন কমিয়ে মিয়ানমার থেকে সরবরাহ নিচ্ছে। তবে খনিগুলো সেনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। চীন-সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্যগুলোতে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে এসব খনিজের দখল।
বিশ্বের অন্যতম পুরোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইনডিপেনডেন্স অর্গানাইজেশন (KIO) গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিরল খনিজ খনি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এদিকে ইউএস লবিস্টদের দুটি প্রস্তাব সামনে এসেছে—
- যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি KIO’র সঙ্গে কাজ করুক
- KIO ও জান্তা সরকারের মধ্যে চুক্তি করিয়ে যৌথভাবে খনিজ উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হোক।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রথম প্রস্তাব অবাস্তব। কাচিন রাজ্য স্থলবেষ্টিত, যেকোনো উত্তোলনের কাজে জান্তার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল, যুদ্ধক্ষেত্র ও চীন-ভারতের দুর্গম এলাকায় পাড়ি দিতে হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আরও বিভ্রান্তিকর। এটি রাজনৈতিক আন্দোলনকে শুধুই ব্যবসা হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
KIO সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়ছে। তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি রয়েছে। তারা কেবল বাণিজ্যের স্বার্থে নিজেদের লক্ষ্য বিসর্জন দেবে না। চীন তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ, তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া কঠিন।
এদিকে মিয়ানমারে বিরল খনিজ খনি সবচেয়ে দ্রুত বিস্তার করছে আরেকটি গোষ্ঠীর হাতে—ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (UWSA)। এটি এশিয়ার অন্যতম বড় অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনী। চীনের সহায়তায় গড়ে ওঠা এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণাধীন খনিগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার শুধু অকার্যকর নয়, চীনের স্বার্থে কাজ করার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, মিয়ানমারে এখন চীনের প্রভাব আরও গভীর।
বছরের শুরুতে ইউএসএআইডির বাজেট কমানো হয়েছে। এতে চীন রাজনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এখন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ফলে এই প্রভাব আরও বাড়বে।
মিয়ানমারের জান্তারা এই সিদ্ধান্তকে নিজেদের নির্বাচনী বৈধতা প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। তারা দেশে-বিদেশে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে পারবে। তবে চীনকে তারা কখনোই ছেড়ে দেবে না। কারণ অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তায় চীনই তাদের প্রধান ভরসা।
অন্যদিকে প্রতিরোধ আন্দোলন, যারা বর্তমানে মিয়ানমারের অর্ধেকের বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা এই পদক্ষেপে হতাশ। বাইডেন প্রশাসন বার্মা অ্যাক্ট পাস করলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ হয়নি। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন বরাবরই ছিল প্রতীকী। এখন সেটিও তুলে নেওয়া হয়েছে।
বছরের পর বছর ফাঁকা আশ্বাসে অভ্যস্ত এই আন্দোলনের যোদ্ধারা পশ্চিমা বিশ্বের ওপর আস্থা হারিয়েছে। এখন তারা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হচ্ছে।

