২০২৩ সালে আয়ারল্যান্ডে মাদকবিরোধী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভিযান চালানো হয়। আটলান্টিকে তুমুল ঝড়ের মধ্যে নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে নেমে সেনারা নিয়ন্ত্রণ নেয় একটি কনটেইনার জাহাজের। প্যানামা পতাকাবাহী সেই জাহাজ এমভি ম্যাথিউ থেকে উদ্ধার হয় ২ দশমিক ২ টন কোকেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫৭ মিলিয়ন ইউরো।
এই অভিযান ছিল শুধু প্রতীকী নয় বরং আয়ারল্যান্ডে কোকেনের বিস্তার ও পাচারের ভয়াবহ চিত্রও তুলে ধরে। দেশটির রাজস্ব বোর্ড জানিয়েছে, গত তিন বছরে রেকর্ড পরিমাণ কোকেন জব্দ করা হয়েছে। শুধু ২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত ১৫০টির বেশি অভিযান চালিয়ে প্রায় ১ দশমিক ৫ টন কোকেন জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১ জুলাই এক অভিযানে ধরা পড়ে ৪০০ কেজি কোকেন, যার মূল্য ৩১ মিলিয়ন ইউরো।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে- কলম্বিয়ায় কোকা উৎপাদন ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭০৮ টনে। আগের বছরের তুলনায় যা ৩৪ শতাংশ বেশি। উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে পাচারকারীরা নতুন রুট খুঁজছে, আর আয়ারল্যান্ডের দীর্ঘ উপকূল হয়ে উঠছে সহজ টার্গেট।
জাতীয় মাদক ও সংগঠিত অপরাধ ব্যুরোর প্রধান শেমাস বোল্যান্ড জানান- “আয়ারল্যান্ডে কিছু নামাতে পারলেই তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢুকে যায়।” তার মতে, এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সমুদ্রপথে ‘ড্রপ-অফ’। এমভি ম্যাথিউও ঠিক এই কৌশল ব্যবহার করতে চেয়েছিল।
জাহাজটি ক্যারিবীয় দ্বীপ কুরাসাও থেকে ছেড়ে আসে। পরিকল্পনা ছিল—সমুদ্রে গিয়ে কোকেন একটি মাছ ধরার ট্রলারে তোলা হবে। ট্রলারটি আয়ারল্যান্ডে কেনা হয়েছিল এবং এর পেছনে অর্থ জুগিয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র। তবে পরিকল্পনা ভেস্তে যায় যখন ট্রলারটি দুর্ঘটনায় ডুবে যায়।
ফলে জাহাজের ক্রুরা ভয়েস মেসেজে যোগাযোগ করতে থাকে দুবাইয়ে থাকা “ক্যাপ্টেন নোয়া” নামে পরিচিত গডফাদারের সঙ্গে। এরপর আইরিশ নৌবাহিনীর টহলজাহাজ এলই ডব্লিউবি ইয়েটস অভিযান চালায়। সতর্কবার্তা সত্ত্বেও নৌবাহিনী গুলি ছোড়ে এবং বিশেষ বাহিনী রেঞ্জার্স হেলিকপ্টার থেকে নেমে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
কিনাহান গ্যাংয়ের ছায়া
আইরিশ পুলিশের সহকারী কমিশনার অ্যাঞ্জেলা উইলিস জানান, জব্দ হওয়া কোকেনের পেছনে কিনাহান গ্যাং জড়িত থাকতে পারে। এই গ্যাংয়ের প্রধান ড্যানিয়েল কিনাহান দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। মে মাসে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ডাবলিনে আনা হয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, মূল গডফাদারকেও দেশে ফেরানোর প্রস্তুতি চলছে।
জুলাইয়ের শুরুর দিকে এমভি ম্যাথিউ মামলায় আট নাবিককে মোট ১২৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, “আয়ারল্যান্ড কোনো সহজ লক্ষ্য নয়।”
ভয়াবহ আসক্তি
আয়ারল্যান্ডে কেবল পাচারই নয়, ভোক্তার সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। হেলথ রিসার্চ বোর্ড জানিয়েছে, গত সাত বছরে কোকেন আসক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ২৫০ শতাংশ। ২০২৪ সালেই রাটল্যান্ড সেন্টার জানিয়েছে, কোকেন ব্যবহারে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে।
গালওয়ের আসক্তি বিশেষজ্ঞ জো ট্রেসি বলেন- “এখন কোকেন যেন সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে গেছে। বিয়ে, অন্ত্যেষ্টি, যেকোনো অনুষ্ঠানে এটি পাওয়া যায়। বয়স ১৬ থেকে ৯০—সব বয়সের মানুষই ব্যবহার করছে।”
জাতিসংঘের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোকেন ব্যবহারে আয়ারল্যান্ড বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এর উপরে আছে অস্ট্রেলিয়া, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস। তবে এই তথ্য ২০১৯ সালের ওপর ভিত্তি করে। বাস্তবে এর ব্যবহার আরও বেড়েছে।
অ্যালকোহল সেবন সামগ্রিকভাবে কমলেও ‘বিঞ্জ ড্রিঙ্কিং’ বা একসাথে অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের কারণে মানুষ কোকেন ব্যবহারের নেপথ্যের ভয়াবহ অপরাধ চক্রের বিষয়টি ভুলে যাচ্ছে।
আয়ারল্যান্ড মাত্র ৫৪ লাখ মানুষের দেশ হলেও ৩২০০ কিলোমিটার উপকূলরেখা পাচারকারীদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। নৌবাহিনীর হাতে আছে মাত্র আটটি জাহাজ, যার মধ্যে একসঙ্গে সর্বোচ্চ তিনটি সমুদ্রে যায়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের আছে মাত্র দুটি জাহাজ। ফলে পুরো উপকূল নিরাপদ রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আয়ারল্যান্ডের কোকেন সংকট এখন দ্বিমুখী—একদিকে ইউরোপে মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে দেশটি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, অন্যদিকে ভেতরে বাড়ছে আসক্তি। পুলিশের ভাষায়, বার্তাটি স্পষ্ট—আয়ারল্যান্ড সহজ লক্ষ্য নয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট কাটাতে আইনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

