পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরের পুরনো শহরাঞ্চলে অবস্থিত ঐতিহাসিক এলাকা ‘গুমটি বাজার’। শত বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ এই বাজার ছিল একসময় জমিদার, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের লেনদেনের প্রাণকেন্দ্র। এখানেই বাস করতেন উপমহাদেশের প্রভাবশালী মহাজন বুলাকী মল, যিনি ইতিহাসে বেশি পরিচিত ‘বুলাকী শাহ’ নামে। তার আর্থিক প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে বলা হয়, লাহোর শহরের প্রায় অর্ধেক মুসলমান বাসিন্দা কোনো না কোনো সময় তার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। আজ সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসের বড় একটি অংশ বিস্মৃতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।
মহাজন বুলাকী শাহের উত্থান-
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে লাহোরে বুলাকী শাহ ছিলেন অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের। তিনি ঋণ দিয়ে সুদে অর্থ আয় করতেন এবং সময়ের অন্যতম শক্তিশালী মহাজন হিসেবে পরিচিত হন। বলা হয়, তার নথিপত্রে অসংখ্য জমিদার, কৃষক এবং ব্যবসায়ীর ঋণের হিসাব লিপিবদ্ধ ছিল। অনেকেই জমি বা গয়না বন্ধক রেখে তার কাছ থেকে অর্থ ধার করতেন। সমাজে তার অবস্থান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে প্রভাবশালী জমিদাররাও তার ঋণের বোঝা বহন করতেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক লেখায় উল্লেখ আছে, বুলাকী শাহের কাছে নারী ঋণগ্রহীতাদের জন্যও আলাদা আসনের ব্যবস্থা ছিল। তারা যখন বিয়ে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ ধার নিতে আসতেন, তিনি সম্মানের সঙ্গে তাদের বসাতেন এবং বন্ধক হিসেবে আনা গয়না বা সম্পদ গ্রহণ করতেন। এই ব্যক্তিগত যত্নশীলতা তাকে সাধারণ মানুষের কাছেও সম্মানিত করেছিল।
মহাজনী ব্যবস্থার প্রভাব-

পাঞ্জাবের অর্থনৈতিক ইতিহাসে বুলাকী শাহের নাম এক বিশেষ অধ্যায়ের অংশ। ইতিহাসবিদ ইশতিয়াক আহমেদের মতে, সেই সময় পাঞ্জাবের প্রায় প্রতিটি শ্রেণিই কোনো না কোনোভাবে মহাজনদের কাছে ঋণী ছিল। তবে মুসলিম সম্প্রদায় এই অর্থনৈতিক দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছিল। এই প্রেক্ষাপটে বুলাকী শাহের ব্যক্তিত্ব ছিল ব্যতিক্রমী—তিনি কঠোর ঋণদাতা হয়েও অনেক ক্ষেত্রে মানবিকতার পরিচয় দিতেন।
চিত্রসাংবাদিক এফ.ই. চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছে, লাহোরের প্রায় অর্ধেক মুসলমানই বুলাকী শাহের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তিনি অসুস্থ হলে অনেক ঋণগ্রহীতা তার খোঁজ নিতে আসতেন, আর এই সুযোগে তিনি অনেক ছোট ঋণ মওকুফ করতেন। যদিও বড় অঙ্কের ঋণগ্রহীতারা এই সুবিধা পেতেন না, তবু তার এই দয়ার দৃষ্টান্ত সেই সময়ে আলোচিত হয়ে ওঠে।
ঋণ সংক্রান্ত বিরোধ ও মামলাবাজি-
বুলাকী শাহের ঋণ কার্যক্রম নিয়ে নানা সময়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমার ঘটনা ঘটেছে। ১৯০১ সালের একটি মামলায় দেখা যায়, তিনি ব্রিটিশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা টিজি একার্সকে দেড় হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন তিন শতাংশ মাসিক সুদের হারে। আদালত প্রথমে সুদের হারকে অত্যধিক বলে রায় দেয় কিন্তু লাহোর হাইকোর্ট পরে জানায়, একার্স নিজে চুক্তিতে সই করেছিলেন এবং কোনো প্রকার জোরজবরদস্তি হয়নি। আদালত বুলাকী শাহের পাওনা মঞ্জুর করে দেন।
১৯১৪ সালের আরেকটি মামলায় বুলাকী শাহ বন্ধক রাখা জমি দখল করতে চাইলে হাইকোর্ট তার বিরুদ্ধে রায় দেয়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, তার ঋণদানের কার্যক্রম কেবল মুসলমানদের নয়, ইউরোপীয় ও হিন্দু গ্রাহকদের সঙ্গেও যুক্ত ছিল।

পারিবারিক জীবন ও বিলাসবহুল প্রাসাদ-
বুলাকী শাহের পারিবারিক জীবন নিয়েও বহু গল্প প্রচলিত আছে। সাংবাদিক মজিদ শেখের একটি লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, একবার তিনি ছেলেকে টবি বাজারের নর্তকীদের আসরে অনুসরণ করে নিজেই সেখানে হাজির হন। পুত্র যে পরিমাণ অর্থ খরচ করছিল, তিনি দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করে মঞ্চ মাতিয়ে দেন। এরপর পুত্র বুঝতে পারে যে নর্তকীদের আকর্ষণ কেবল ধন-সম্পদের জন্য এবং সে পথ ত্যাগ করে।
১৯২৯ সালে গুমটি বাজারে নির্মিত তার চারতলা ভবনটি সে সময় লাহোরের অন্যতম সেরা স্থাপত্য ছিল। সিমেন্টের লতা-পাতার নকশা, খিলান দেওয়া বারান্দা এবং লোহার শিল্পকর্ম দিয়ে সজ্জিত এই ভবন এখন ভগ্নপ্রায়। বর্তমানে এখানে চামড়ার পণ্য ও রং-রাসায়নিকের দোকান রয়েছে, আর এলাকাবাসীর অনেকেই ভবনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত নন।

দেশভাগের প্রেক্ষাপট ও পরিবারের প্রস্থান-
১৯৪৭ সালের দেশভাগে লাহোরের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূল বদলে যায়। দাঙ্গার সময় বুলাকী শাহের ঋণের নথিপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে দাবি করা হয়েছে, তিনি তার ঋণগ্রহীতাদের তালিকা ভারতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিক মজিদ শেখ উল্লেখ করেন, ভারতে পৌঁছে তিনি তালিকার পাতাগুলো ছিঁড়ে দেন এবং সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
বুলাকী শাহের নাতনি সানা মেহেরা সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন, তার দাদি বিজয়লক্ষ্মী মেহেরা প্রায়ই লাহোরের স্মৃতিচারণ করতেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শহরে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তাদের পরিবার আজ দেরাদুনে বসবাস করলেও লাহোরের সঙ্গে সম্পর্ক রয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।

উত্তরাধিকার ও প্রভাব-
বুলাকী শাহের ব্যবসায়িক দক্ষতা ও প্রভাবশালী অবস্থান তাকে লাহোরের আর্থিক ইতিহাসে এক কিংবদন্তি চরিত্রে পরিণত করেছে। যদিও মহাজনী ব্যবস্থা প্রায়ই সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক দুর্ভোগ বয়ে এনেছিল, তবু বুলাকী শাহের মানবিক দিক এবং ঋণগ্রহীতাদের সহায়তা করার কিছু উদাহরণ তাকে ব্যতিক্রমী করেছে।
আজ লাহোরের গুমটি বাজারে দাঁড়িয়ে সেই রাজকীয় ভবনের দিকে তাকালে কেবল ভগ্ন স্মৃতিই চোখে পড়ে। এলাকাবাসীর অনেকেই জানেন না যে একসময় এই শহরের অর্ধেক মানুষ এই মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতেন। তার নাম আজ কেবল ইতিহাসের পাতায় বেঁচে আছে কিন্তু লাহোরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের যে অধ্যায় তিনি লিখে গেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক।

