এই সপ্তাহে বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চীনের এক বিশাল সামরিক মহড়া, যা শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপন নয়, বরং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে চীনের সামরিক শক্তি, কূটনৈতিক প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন অগ্রাধিকার তুলে ধরার একটি মহৎ স্টেজ। রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং ইরানসহ মোট ২৬টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এতে অংশগ্রহণ করবেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কিম জং উনের উপস্থিতি ১৯৫৯ সালের পর প্রথমবারের মতো একটি চীনা সামরিক মহড়ায়।
বেইজিংয়ে একটি বিশাল সামরিক শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শক্তির প্রদর্শনী।
পশ্চিমবিরোধী সমন্বয় ও কূটনৈতিক বার্তা বিশ্লেষকরা রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার যৌথ সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে “উত্তালক এক অক্ষ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক সংঘাতগুলোতে এই সহযোগিতা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বেইজিংয়ের এই প্রদর্শনী পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ করার শি জিনপিং-এর লক্ষ্যকে প্রতিফলিত করছে। চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের তুলনায় এই মহড়া চীনের ক্ষমতা এবং প্রস্তুতির প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং মঙ্গলবার বেইজিংয়ে আলোচনা করছেন।
সামরিক আধুনিকীকরণ ও অস্ত্র প্রদর্শনী মহড়ায় চীনের সামরিক আধুনিকীকরণের নানা দিক ফুটে উঠবে। প্রদর্শিত হবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, অ্যানম্যানড আন্ডারওয়াটার ড্রোন এবং পঞ্চম প্রজন্মের জেট বিমান, বিশেষভাবে J-20। গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই জেটগুলো ক্রমশ রুশ ইঞ্জিনের পরিবর্তে চীনা ইঞ্জিন ব্যবহার করছে, যা চীনের স্বনির্ভর সামরিক নীতি এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার প্রমাণ। সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউক্রেনে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতা থেকে শিক্ষা নিয়ে চীন তার সম্ভাব্য তাইওয়ান সংঘাতের প্রস্তুতি করছে। মহড়ার মাধ্যমে চীন একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাচ্ছে যে, তাইওয়ানকে সমুদ্রপথে যে কোনো সহায়তা প্রদান করা হলে তা প্রতিহত করার সক্ষমতা চীনের হাতে রয়েছে।
বেইজিংয়ের কেন্দ্রে অবস্থিত তিয়ানআনমেন স্কোয়ার বন্ধ করার প্রস্তুতি আগে থেকেই শুরু হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রভাব ও জাতীয়তা মহড়া কেবল আন্তর্জাতিকভাবে শক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার নয়; এটি অভ্যন্তরীণভাবে দেশের জনগণের মধ্যে জাতীয়তা এবং শি জিনপিং-এর নেতৃত্বের বৈধতা নিশ্চিত করার একটি কার্যকর কৌশল। বেইজিং শহরজুড়ে ২ লাখের বেশি পতাকা, ফুলের সমাবেশ এবং যুদ্ধকালীন গল্পবলি প্রদর্শিত হচ্ছে। ট্যাঙ্ক ও পদাতিক মহড়ার শব্দ শহরজুড়ে শোনা যাচ্ছে, রাস্তা ও সাবওয়ে লাইন বন্ধ, স্কুল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। শহরের নাগরিক জীবন এই মুহূর্তে সাময়িকভাবে পেছনে ঠেকেছে, যা চীনা সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং প্রস্তুতির স্বাক্ষর।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ও রাষ্ট্রীয় প্রচারণা চীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে “জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ যুদ্ধ” হিসেবে বর্ণনা করে। তবে ইতিহাসের এই বর্ণনা প্রায়ই কমিউনিস্ট পার্টির বিজয়কেন্দ্রিক এবং জাতীয়তাবাদী দিককে তুলে ধরে, যেখানে জাতীয়তাবাদী বাহিনীর অবদান কম দেখানো হয়। শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার এই ইতিহাসকে সমর্থনমূলক চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারির মাধ্যমে প্রচার করছে। এই প্রচারণা সামরিক মহড়ার সঙ্গে একত্রিত হয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং জনগণের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করছে।
সামরিক শোভাযাত্রার আগে এক মহড়া অনুশীলনের সময় চীনের সামরিক হেলিকপ্টারগুলো সারি বেঁধে উড়ছে।
অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি চীনের অর্থনীতি ধীরগতি, যুবক বেকারত্ব ও আবাসনের পতনের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ শুল্ক নীতি কারখানার উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। এসব প্রেক্ষাপটে সামরিক মহড়া চীনের শক্তিশালী রূপ প্রদর্শনের পাশাপাশি, বিদেশি কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছে দেশটির স্থিতিশীলতা এবং ক্ষমতা তুলে ধরার প্রচেষ্টা।
বেইজিংয়ের এই মহড়া শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক স্মরণ অনুষ্ঠান নয়; এটি চীনের সামরিক সক্ষমতা, কূটনৈতিক প্রভাব এবং নেতৃত্ব প্রদানের ইচ্ছার সমষ্টি। শি জিনপিং-এর লক্ষ্য বহুমুখী বিশ্ববিন্যাস প্রতিষ্ঠা এবং চীনের নেতৃত্বকে বৈশ্বিক স্তরে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা। এতে তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিসরকে উদ্দেশ্য করে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠানো হচ্ছে।
পরিশেষে, এই মহড়া চীনের জন্য কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলক, যা দেশটির সামরিক আধুনিকীকরণ, কূটনৈতিক কৌশল এবং অভ্যন্তরীণ সমর্থনকে একসাথে প্রদর্শন করছে।