ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই দেশটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার ভারত সঙ্গে সম্পর্ক গভীর সংকটে পড়েছে। দুই দেশের মধ্যে যে আস্থার ভিত্তি কয়েক দশকে গড়ে উঠেছিল, তা আজ ভেঙে পড়ার উপক্রম। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত দুই মাস ধরে ট্রাম্পের ফোন ধরেননি বলে খবর মিলেছে।
ট্রাম্প সম্প্রতি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ককে ‘একপেশে বিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি তিনি এ বছর পরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কোয়াড সম্মেলনে (ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান) যোগ দিতে ভারত সফরের পরিকল্পনাও বাতিল করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি এত দ্রুত ও এত তীব্র হবে, তা কল্পনাও করেনি কেউ।
বন্ধুত্ব থেকে বিরূপ সম্পর্ক-
গত বছর ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর নয়াদিল্লি উল্লসিত হয়েছিল। মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তাঁকে ‘বন্ধু’ বলে অভিহিত করেন এবং আলিঙ্গন ও করমর্দনের ছবি প্রকাশ করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তখন বলেছিলেন, অনেক দেশ ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরত আসা নিয়ে শঙ্কিত হলেও ভারত তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। আত্মবিশ্বাসের জোরে মোদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ওয়াশিংটন সফরে যান। কিন্তু সেই বৈঠক প্রত্যাশিতভাবে ভালো হয়নি।
সাক্ষাতের আগের দিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেনাবাহিনীর বিমানে হাতকড়া ও শিকলে বাঁধা অবস্থায় ভারতীয় নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর ছবি প্রকাশিত হয়, যা নয়াদিল্লিকে বিব্রত করে। বৈঠকে মোদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো অস্ত্র, তেল ও গ্যাস কেনার প্রতিশ্রুতি দিলেও ভারতের ওপর শুল্ক না বাড়ানোর অনুরোধে ট্রাম্প রাজি হননি। কয়েক সপ্তাহ পর তিনি ঘোষণা দেন, বোঝাপড়া না হলে ভারতকে ২৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে—যা চীনের ওপর আরোপিত শুল্কের দ্বিগুণেরও বেশি।
কাশ্মীর সংকট ও নতুন উত্তেজনা-
বাণিজ্য ইস্যুতে ব্যর্থ আলোচনার পর এপ্রিল মাসে নতুন সংকটে পড়ে ভারত। ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু পর্যটক। এতে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা আবারো চরমে ওঠে। মোদি সরকার শক্ত জবাবের ঘোষণা দেয় এবং ৭ মে পাকিস্তান ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর শিবিরে হামলা চালায়। দুই দেশের মধ্যে দ্রুত সংঘাত শুরু হয়, যেখানে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের এই সংঘাত নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। অবশেষে ১০ মে উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু ট্রাম্প হঠাৎ ঘোষণা দেন, সংঘাত মেটাতে তিনি উভয় পক্ষকে আলোচনায় এনেছেন এবং কাশ্মীর সমস্যার সমাধান তাঁর মধ্যস্থতায় হবে। পাকিস্তান এই দাবি স্বাগত জানালেও নয়াদিল্লি ক্ষুব্ধ হয়, কারণ ভারতের দীর্ঘদিনের নীতি হলো কাশ্মীর ইস্যু দ্বিপাক্ষিকভাবে মেটানো, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ নয়।
কূটনৈতিক অস্বস্তি ও ট্রাম্পের চাপ-
ট্রাম্পের এই আচরণ মোদিকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারি ও শুল্ক ইস্যুতে সমাধানের আশায় তিনি ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করতে চাননি, কিন্তু মধ্যস্থতার প্রস্তাব মেনে নেওয়াও ভারতের নীতি বিরোধী ছিল। তাই মোদি সরাসরি ট্রাম্পকে ফোন করে জানান, কাশ্মীর ইস্যুতে কোনো তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা ভারত মেনে নেবে না।
পাকিস্তান এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে দেখে যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব বাড়াতে চেষ্টা চালায়। ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষা বুঝে তারা তাঁকে মনোনয়ন দেয়। উৎসাহিত হয়ে ট্রাম্প ১৭ জুন মোদিকে ফোন করেন এবং কানাডায় জি-৭ সম্মেলন শেষে ওয়াশিংটন হয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করার আহ্বান জানান। এটিই ছিল মোদির জন্য ‘শেষ ধাক্কা’। তিনি স্পষ্টভাবে ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং এরপর থেকে তাঁদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
ট্রাম্প এর পরপরই রুশ তেল কেনার কারণে ভারতের শুল্কহার ৫০ শতাংশে উন্নীত করেন এবং বাণিজ্য আলোচনাও স্থগিত করেন। এতে সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং মোদি সরকারের ওপর শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ বাড়ে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, অস্ত্র এবং কূটনৈতিক সমর্থনের প্রধান উৎস হওয়ায় নয়াদিল্লির হাতে বিকল্প খুবই সীমিত।
নতুন মিত্রতার খোঁজে নয়াদিল্লি-
এই সংকটকালীন সময়ে ভারত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সচেষ্ট হয়েছে। ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ছিল। সাত বছর পর গত ৩১ আগস্ট মোদি চীন সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সি বলেন, “হাতি আর ড্রাগন একসঙ্গে নাচুক।” তবে আস্থার সংকট এখনো রয়ে গেছে।
মোদির আরেকটি ভরসা রাশিয়া। চীন সফরে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা তাঁর লিমুজিনে আলোচনা করেন এবং এ বছরের শেষ দিকে তাঁকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান। যদিও ইউরোপে রাশিয়া এখনও কূটনৈতিকভাবে একঘরে, ভারতের জন্য তাদের সহায়তার ক্ষমতা সীমিত।
এছাড়া জাপানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চেষ্টা করছেন মোদি। চীন সফরের আগে টোকিও সফরে গিয়ে তিনি জাপানের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। তবে দেশটির প্রভাব ভারতের বর্তমান সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়।
সব মিলিয়ে নয়াদিল্লি আজ কূটনৈতিকভাবে জটিল এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন না হলে ভারতের জন্য সামনে আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

