পল ম্যাকার্টনির সেই বিখ্যাত গানের মতো, আমেরিকাও যেন বলছে—“লিভ অ্যান্ড লেট ডাই।” অর্থাৎ, বাঁচতে চাইলে পুরনো কৌশল ছাড়তে হবে এবং নতুন পথ নিতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল একটি নাটকীয় মোড়। এতে বলা হয়েছে, চীন ও রাশিয়ার মতো বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা থেকে সরে এসে দেশীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে।
আশ্চর্যজনকভাবে, যিনি আগে চীনের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি “স্ট্র্যাটেজি অব ডিনায়াল”-এর প্রবল সমর্থক ছিলেন, আন্ডার সেক্রেটারি অব ওয়ার ফর পলিসি এলব্রিজ কোলবিই এখন বাস্তববাদী সুরে কথা বলছেন। মার্কিন সিনেটের শুনানিতে তিনি বলেছেন—“তাইওয়ান গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অস্তিত্বগত স্বার্থ নয়।” অর্থাৎ, তাইওয়ানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামানো ঠিক হবে না, এমনই তার মত।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে—এটা কি হঠাৎ নতুন গোয়েন্দা তথ্যের ফল? নাকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রভাব? যাই হোক, বাস্তবতা হলো—আমেরিকা আর সেই পুরনো সুপারহিরো নয়, অন্তত সামরিক দিক থেকে।
চীনের সামরিক শক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন এবং জাহাজ—সবখানেই নতুন প্রযুক্তি দেখা যাচ্ছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৬.৭ গুণ বেশি প্রকৌশলী তৈরি করছে। তাই প্রযুক্তি উন্নয়নের ঝড়ে সামরিক খাতও দ্রুত এগোচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধও চীনের সামনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি আরও ৯০ দিনের জন্য শুল্ক আলোচনা স্থগিত হয়েছে। এর আগে তিন দফায় মার্কিন প্রশাসন চীনের চাপের কাছে পিছু হটেছে। প্রথমে জেনেভায় বাণিজ্য আলোচনায়, এরপর চীনের বিরল খনিজ রপ্তানি বন্ধের পর এবং এখন আবার শুল্কযুদ্ধের বিরতি। সব ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে—চীন সহজ লক্ষ্য নয়।
মার্কিন নীতি-নির্ধারকের বড় বিভ্রান্তি হলো চীনের অর্থনীতি ছোট মনে করা। বিশ্বব্যাংকের আইসিপি পরিসংখ্যান অনুসারে চীনের জিডিপি অনেক কম দেখানো হয়েছে। অথচ স্বাধীন গবেষকরা বলছেন, চীনের প্রকৃত অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত দ্বিগুণ, কিছু বিশ্লেষক মনে করেন আড়াই গুণ। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই ভুল হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিনরা রাশিয়াকে ছোট অর্থনীতি ভেবে অনুমান করেছেন, অথচ বাস্তবে তা অনেক বড়।
চীনের প্রকৃত অর্থনীতি এভাবেই শক্তিশালী। পণ্য ও সেবার মূল্যায়ন বাস্তবের অর্ধেকেরও কম ধরা হয়েছে। ফলে, যদিও কাগজে-কলমে ছোট মনে হচ্ছে, বাস্তবে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি।
এবার যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা ‘স্কাল চার্ট’-এর মুখোমুখি। এই চার্টে প্রতিটি মার্কিন বনাম চীনের পরিসংখ্যান দেখায়—চীনের প্রবণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, মার্কিন তুলনায় বহু গুণ। এ বাস্তবতা মেনে পেন্টাগনের নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল সাজানো হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থনৈতিক দলও চীনের বাস্তব অর্থনীতির সামনে অসহায়।
তবুও অনেক মার্কিন বিশ্লেষক ও রাজনীতিক মনে করেন—চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি কিন্তু নির্ভরশীল আমেরিকার ভোক্তাদের ওপর। এই ভুল ধারণা যতদিন থাকবে, ততদিন তারা ভুল করবে, আর ওয়াশিংটনকে সেই ভুলের খেসারত দিতে হবে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক মঞ্চে।

