২০১২ সাল থেকে কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় রয়েছে। কাতারি কর্মকর্তাদের দাবি, এ সিদ্ধান্ত তাদের এককভাবে নেওয়া নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে এই কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল।
কখন শুরু হয়েছিল হামাস অফিস?
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছর পর, ২০১২ সালে হামাসের শীর্ষ নেতা খালেদ মেশআলসহ অনেকেই দামেস্ক ছেড়ে দোহায় আসেন। তখন থেকেই কাতারে গড়ে ওঠে হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয়। মেশআল, যিনি ১৯৯৭ সালে জর্ডানে ইসরায়েলি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যান, সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এরপর হামাসের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব পান ইসমাইল হানিয়া। তিনি ২০১৭ সালে গাজা ছেড়ে দোহায় চলে আসেন এবং সেখান থেকেই হামাসের নেতৃত্ব দিতেন। তবে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় হানিয়া নিহত হন। বর্তমানে দোহায় অবস্থান করছেন হামাসের শীর্ষ আলোচক খালিল আল-হাইয়া ও প্রবীণ নেতা মুসা আবু মারজুকসহ আরও অনেকে।
কেন কাতার হামাসকে আশ্রয় দিল?
কাতার দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পরিচিত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অন্যদিকে ইরানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ—এই দ্বিমুখী কূটনৈতিক ভূমিকার কারণেই কাতারকে আলোচনার নিরপেক্ষ মঞ্চ হিসেবে দেখা হয়।
গাজা ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েলি অবরোধের মুখে। কাতার এ সময় থেকে ফিলিস্তিনিদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এবং ফিলিস্তিনি ইস্যুকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। হামাসকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল এই দুটি কারণের সমন্বয়।
২০২৩ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা এক নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কাতারি রাষ্ট্রদূত শেখ মেশাল বিন হামাদ আল থানি স্পষ্ট করেন—হামাস অফিস থাকা মানে তাদের নীতিকে সমর্থন নয়, বরং এটি একটি জরুরি যোগাযোগ চ্যানেল। তার ভাষায়, “হামাস অফিস বহুবার মধ্যস্থতার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, যা সংঘাত কমাতে সহায়তা করেছে।”
কূটনীতির কেন্দ্র হিসেবে কাতার
কাতারের ভূমিকা হামাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আরব বসন্তের পর বহু আরব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দোহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এছাড়া ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ও খোলা হয় দোহায়, যা পরবর্তী সময়ে আফগান শান্তি আলোচনার প্রধান ভেন্যু হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—কাতারেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি, আল উদেইদ এয়ারবেস। এই ঘাঁটি ওয়াশিংটনের কাছে কাতারকে অমূল্য কৌশলগত মিত্রে পরিণত করেছে।
দোহায় ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। হামাস নেতাদের উপস্থিতি নিয়ে যেসব কূটনৈতিক ভারসাম্য এতদিন টিকে ছিল, তা এখন হুমকির মুখে। কাতারি প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন—যদি পক্ষগুলো কাতারের মধ্যস্থতাকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে, তবে দোহা তার ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
কাতারের এই কূটনৈতিক পরীক্ষার গল্প আমাদের দেখায়—মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির আলোচনার কেন্দ্র যতটা দরকারি, ততটাই ভঙ্গুর। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি, অন্যদিকে হামাস ও তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়—এই দ্বৈত বাস্তবতার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে কাতার।