কাতারে হামাসের রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা বিশ্বব্যাপী সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। মঙ্গলবার দোহায় সংঘটিত এই হামলায় হামাসের শীর্ষ নেতারা নিহত না হলেও পাঁচজন নিম্নপদস্থ সদস্য এবং কাতারের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা প্রাণ হারান।
হামলাটি কেবল হামাসবিরোধী অভিযান নয়, বরং কাতারের সার্বভৌমত্বের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপ, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ পর্যন্ত সমালোচনার স্রোত দেখা দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে পরিচিত, হামলাটিকে “প্রত্যেকটি দিক থেকে হতাশাজনক” বলে মন্তব্য করেছেন।
জার্মানি, যাদের অবস্থান ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলপন্থী, এটিকে “গ্রহণযোগ্য নয়” বলে আখ্যা দিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সম্ভাব্য উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে সতর্ক করেছে।
তবে এই সব ভাষাগত নিন্দা কি বাস্তব নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলের অতীত আচরণে এর সম্ভাবনা ক্ষীণ। গাজায় চলমান যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক আইন বারবার লঙ্ঘন, হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি, অবকাঠামো ধ্বংস এবং এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পরও ইসরায়েল কার্যত কোনো আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নীতিগত পরিবর্তন করেনি।
ইসরায়েলের অবাধ কর্মকাণ্ড-
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট এবং সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেসের জ্যেষ্ঠ গবেষক এইচএ হেলিয়ার বলেন, “এমন হামলার পর ধারণা হতে পারে যে ইসরায়েলের মিত্ররা সমালোচনার সুর পাল্টাবে, কিন্তু ইতিহাস বলে এটা খুব একটা সম্ভাবনাময় নয়।”
তিনি আরও বলেন, “গাজা উপত্যকায় ধ্বংসযজ্ঞ, আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগ, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান ও তিউনিসিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন—কোনো কিছুই ইসরায়েলের প্রতি নীতিগত অবস্থানে বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি। এই হামলাও তেমন কোনো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।”
ইসরায়েল কেবল ফিলিস্তিন নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। ইয়েমেনে হুতি সরকারপ্রধানকে হত্যার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশটিতে ফের হামলা চালানো হয়। রাজধানী সানায় এক আবাসিক এলাকায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন।
একই সপ্তাহে গাজার অবরোধ ভাঙতে উদ্যোগী শান্তিপূর্ণ “গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা”তে দুই দফা ড্রোন হামলার অভিযোগ উঠেছে, যা বর্তমানে তিউনিসিয়ার বন্দরে অবস্থান করছে। এই কর্মকাণ্ড সিরিয়া, লেবানন ও ইরানেও বারবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে।
কাতারের কূটনৈতিক গুরুত্ব-
কাতারের কূটনৈতিক প্রভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই হামলার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হামলাটি হামাস নেতাদের প্রাণঘাতী না হলেও কাতারের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সেন্ট জোসেফ ইউনিভার্সিটি অব বেইরুতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক অধ্যাপক করিম এমিল বিটার বলেন, “বিশ্ব জনমত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে মূল পরিবর্তন এসেছে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের কারণে। দুর্ভিক্ষ এবং শীর্ষস্থানীয় ইসরায়েলি শিক্ষাবিদদের গণহত্যার অভিযোগ জনমতকে আরও শক্তিশালী করেছে।”
বিটার মনে করেন, কাতারে হামলা মূলত উপসাগরীয় দেশগুলোর অবস্থান কঠোর করবে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি উপসাগরীয় দেশের নেতা দোহায় সংহতি জানাতে সফর করেছেন বা করার পরিকল্পনা করছেন।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান বিন জাসিম আল থানি জানিয়েছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করছে।
ইউরোপের কড়া সমালোচনা-
পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছে। স্পেন সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর জন্য জ্বালানি বহনকারী জাহাজগুলোর তাদের বন্দর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েন ইইউ-ইসরায়েল মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত করার মতো নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তবুও এই পদক্ষেপগুলো রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর যে মাত্রার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল তার তুলনায় নগণ্য।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ও ‘লাল রেখা’ অতিক্রম-
হামলার পর ইসরায়েলি নেতৃত্ব অনুতাপের কোনো লক্ষণ দেখায়নি। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোজাসাপ্টা বলেছেন, “হামলা ইসরায়েল শুরু করেছে, ইসরায়েল পরিচালনা করেছে, এবং তার সম্পূর্ণ দায়ভার ইসরায়েল নিচ্ছে।”
অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ আরো এগিয়ে গিয়ে বলেন, ইসরায়েলের শত্রুরা “বিশ্বের কোথাও” ইসরায়েলের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে না।
কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রব গেইস্ট পিনফোল্ড বলেন, “ইসরায়েল বারবার ‘লাল রেখা’ অতিক্রম করেছে, কিন্তু কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। ইউরোপীয় দেশগুলো যত কিছুই বলুক না কেন, এখনো এমন কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেই যা ইসরায়েলকে হামলা থেকে বিরত রাখবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা-
পিনফোল্ডের মতে, ইসরায়েলের নীতি পরিবর্তনের সম্ভাব্য একমাত্র প্রভাবক হলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ইসরায়েলকে বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়, অস্ত্র সরবরাহ করে এবং কূটনৈতিকভাবে রক্ষা করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলবিরোধী প্রস্তাব বিরল হওয়ার পেছনেও ওয়াশিংটনের প্রভাব রয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে যারা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করেছিলেন।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ইসরায়েলের পক্ষে বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যার মধ্যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া অন্যতম।
ইসরায়েলি ডানপন্থীরা মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ দিয়েছে, যার মধ্যে পশ্চিম তীর দখল পরিকল্পনাও রয়েছে।
গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে আহ্বান জানালেও তার প্রশাসন ইসরায়েলের অবস্থানকেই সমর্থন করছে। তিনি এমনকি গাজাকে “গাজা রিভিয়েরা”তে রূপান্তরের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা সমালোচকদের মতে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনা।
হামলা নিয়ে মার্কিন অবস্থান-
কাতারে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য ফিলিস্তিন ইস্যুর তুলনায় ভিন্নতর প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। ক্ষমতায় ফেরার পরপরই ট্রাম্প কাতার সফর করেছিলেন।
হামলার ব্যাপারে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তারা শেষ মুহূর্তে বিষয়টি জানতে পেরেছিল এবং কাতারকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল। এই ব্যাখ্যা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়মুক্তি দিতে পারে, তবে ইসরায়েলের প্রতি হতাশার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এখনও মেলেনি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যদি গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলের বহিরাগত অভিযান বন্ধে চাপ প্রয়োগ করে, তাহলে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।
করিম এমিল বিটার বলেন, “বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খেলায় একমাত্র গেমচেঞ্জার যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প।”


