প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে চিরতরে ধ্বংস করতে মরিয়া ইজরায়েল এবার কাতারকে লক্ষ্য করেছে। তেল আবিবের বিমানবাহিনী কাতারের রাজধানী দোহা এবং বিভিন্ন স্থানে বোমাবর্ষণ চালিয়েছে। এই হামলার প্রেক্ষাপটে পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশ কাতারের নিরাপত্তা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কাতারে হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে মার্কিন অবস্থান এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ইজরায়েলি বায়ুসেনা দোহার আকাশে বিমান হামলা চালায়। এই হামলার আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তথ্য দেওয়া হয়েছিল। সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ট্রাম্পের ‘আশীর্বাদ’ মেলার পরই ইজরায়েলি পাইলটরা কাতারের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়েছে।
তবে হামলার বিষয়ে ট্রাম্প পরবর্তীতে গণমাধ্যমে অস্বাভাবিক যুক্তি দিয়ে বলেন, “ইজরায়েল আগেই আমাদের সতর্ক করেছিল, কিন্তু তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে আক্রমণ আটকানো যায়নি।”
আল জাজিরা জানিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবেই ট্রাম্প হামাসের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। কারণ তিনি ইরান সমর্থিত হামাস নেতাদেরকে ইজরায়েলের হাতে খুন হতে চেয়েছেন।
অন্যদিকে, দোহার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি জানিয়েছেন, “হামলা শুরু হওয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আমেরিকা থেকে ফোন পাই আমরা। বিস্ফোরণের শব্দে গোটা এলাকা কাঁপছিল।” কাতারে মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি ছাউনি এবং প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকার পরও ইজরায়েলি বিমান হামলা নির্বিঘ্নে চালানো সম্ভব হওয়ায় কাতার প্রশাসন এটিকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছে।
মে মাসে ট্রাম্প প্রথম বিদেশ সফরে কাতারকে বেছে নেন এবং ৪০ কোটি ডলারের বিলাসবহুল বিমান উপহার পান। উড়োজাহাজটি ‘উড়ন্ত প্রাসাদ’ নামে পরিচিত।
এছাড়া ২,৪৩৫ কোটি ডলারের আর্থিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা কাতারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। তবে ইজরায়েলি হামলার সময়ে মার্কিন ফৌজ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় কাতারের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জুনে ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষের সময় যুক্তরাষ্ট্র কাতারের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তেহরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দোহার আকাশ দিয়ে উড়ে গেলে মার্কিন প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ব্যবহার করে তা ধ্বংস করা হয়েছিল। ফলে তখন কাতারের উপর মার্কিন ভরসা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মধ্যে ইজরায়েলি হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ নিরব থাকায় কাতার প্রশাসন হতবাক হয়। আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে থাকা পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম মার্কিন সামরিক ছাউনির উপস্থিতি কার্যকর হয়নি।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট জানান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুত দোহাকে সতর্ক করতে বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে দায়িত্ব দেন। তবে সময় মতো সতর্ক করা সম্ভব হয়নি। ক্যারোলিন উল্লেখ করেছেন, হামাস নির্মূলের লক্ষ্যে ইজরায়েলের পদক্ষেপকে যুক্তিসঙ্গত মনে করা হচ্ছে।
ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ পোস্ট দিয়ে দাবি করেন, দোহায় হামলার সিদ্ধান্ত তিনি নেননি এবং এটি তাঁর দায়িত্ব নয়।
তিনি আরো বলেন, “কাতারের ভিতরে একতরফা বোমাবর্ষণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের স্বার্থের বিপরীত। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু একটি স্বাধীন দেশে এভাবে আক্রমণ করা অনুচিত।” হামলার পর ট্রাম্প কাতারকে আশ্বাস দেন, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর হবে না।
কাতার এ ঘটনার পর আরব দেশগুলির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং তুরস্ক একযোগে ইজরায়েলকে নিন্দা করেছে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য হামাসের কাছে পণবন্দি থাকা ইহুদিরা মুক্তি পাওয়া আরো কঠিন হয়ে গেছে।
ইজরায়েলি গণমাধ্যম জানায়, প্রথমে দোহা অভিযানকে ‘অপারেশন আতজেরেত হাদিন’ বা ‘বিচারের দিন’ নাম দেওয়া হয়। পরে অভিযানকে ‘অপারেশন সামিট অফ ফায়ার’ নামে নামকরণ করা হয়। কাতারে হামাসের শীর্ষ নেতৃত্ব জড়ো হওয়ার খবর পাওয়ার পরই এই আক্রমণ চালানো হয়। তেল আভিভের দাবি, হামলা সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। তবে পাল্টা বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, তাদের নেতৃত্বের কেউ আহত হয়নি।
আল জাজিরা জানিয়েছে, ইজরায়েলি বিমান বাহিনী কাতারের মোট ১২টি স্থানে বোমাবর্ষণ করেছে। ১৫টি লড়াকু জেট দোহার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। হামলার ফলে পাঁচ হামাস সদস্য এবং একজন স্থানীয় রক্ষীর মৃত্যু হয়। হামলার পদক্ষেপকে হামাস ‘কাপুরুষোচিত’ উল্লেখ করেছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কাতারে হামলার পর হামাসের কাছে পণবন্দি ইহুদিদের মুক্তি আরো কঠিন হয়ে গেছে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ইরান এই সুযোগ নিতে পারে। তেহরান সফল হলে ইজরায়েল ও আমেরিকার বিপদ বৃদ্ধি পাবে। পরিস্থিতি আরো জটিল করতে কাতারের বায়ুসেনার কাছে রয়েছে ৩৬টি ফরাসি রাফাল, ২৪টি ইউরোফাইটার এবং ৩৫টি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান।
এ ঘটনার ফলে কাতার, পশ্চিম এশিয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন সমালোচকরা ট্রাম্পের পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে উল্লেখ করছেন।
ব্রিটিশ-আমেরিকান সাংবাদিক মেহদি হাসান বলেছেন, “উপহারে বিলাসবহুল বিমান নিয়ে ট্রাম্প কাতার ফিরে গেলেন, আর সাধারণ মানুষ পাচ্ছে মার্কিন বিশ্বাসঘাতকতা।” ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক আন্দ্রেয়াস ক্রিগের মন্তব্যও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
ট্রাম্প ৭ সেপ্টেম্বর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ হামাসকে সতর্ক করেছেন, অপহৃতদের দ্রুত মুক্তি দিতে বলেন। একই সঙ্গে ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হওয়ার হুমকিও দেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইজরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে আক্রমণ চালায় এবং কিছু ইজরায়েলিকে অপহরণ করে। এরপর নেতানিয়াহু মোসাদের মাধ্যমে মুক্তির চেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু পূর্ণ সাফল্য পাননি।
কাতার এই ঘটনার পর হামাসের সঙ্গে মধ্যস্থতার ভূমিকা ন্যায্য করতে ব্যর্থ হয়। তেল আভিভের পদক্ষেপে পুরো মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। প্রাথমিকভাবে হামলার পরিকল্পনা অনুযায়ী হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে লক্ষ্য করা হয়। তবে তাদের পাঁচ সদস্য নিহত হলেও নেতৃত্বের কেউ আহত হয়নি।
ফলে, কাতারে হামলার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের জন্য কূটনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এটি পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এ সমস্যার দিকে তীব্রভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।