জাতিসংঘের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয় ১৯৫৬ সালে। গন্তব্য ছিল মিসরের সিনাই উপদ্বীপ ও গাজা উপত্যকা। সে সময় গাজা মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মূল কারণ ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের যৌথ হামলা মিসরের সুয়েজ খালে। সংঘাত থামাতে মধ্যস্থতাকারী বাহিনী হিসেবে জাতিসংঘের উদ্যোগে ওই শান্তিরক্ষী পাঠানো হয়েছিল।
আজ আবার গাজা রক্তে ভাসছে। টানা দুই বছর ধরে ইসরায়েলের হামলা চলছে। সামনে জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশন। এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই প্রশ্ন করছেন—জাতিসংঘ এখন গাজায় কী করতে পারে এবং কেন তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যদিও সুয়েজ সংকট ও গাজার পরিস্থিতি পুরোপুরি এক নয়, তবে ১৯৫৬ সালের অভিজ্ঞতা এখনো শিক্ষা দেয় যে জাতিসংঘ চাইলে বিকল্প পথে এগোতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ইসরায়েলের হামলায় শুরু থেকেই নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছে। অনেক আইন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ এটিকে সরাসরি গণহত্যা বলছেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত ছয়বার ভেটো দিয়ে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ ঠেকিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সর্বশেষটি গত শুক্রবার। এসব প্রস্তাবে যুদ্ধ থামানো এবং অবাধ মানবিক সহায়তা প্রবেশের দাবি জানানো হয়েছিল।
এর আগে ১৯৫৬ সালেও নিরাপত্তা পরিষদ ভেটোর কারণে অচল হয়ে পড়েছিল। আক্রমণকারী দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স তখন ভেটো দিয়েছিল। সেই অবস্থায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৫০ সালের ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ প্রস্তাব ব্যবহার করে নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটায় এবং শান্তিরক্ষী পাঠায়। তখন যুক্তরাষ্ট্রই সাধারণ পরিষদের উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার ব্রিটিশ-ফরাসি-ইসরায়েলি আক্রমণের বিরোধিতা করেছিলেন। সাহসী মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন নিশ্চিত করেছিলেন। মিসরও সেই বাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছিল।
কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। কূটনীতিকরা বলছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই গাজা সংকটকে আন্তর্জাতিকীকরণ চায় না। তাই ১৯৫৬ সালের অভিজ্ঞতা দেখালেও, কার্যকারিতা আজ নির্ভর করছে বড় দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
জাতিসংঘের গণহত্যা ঠেকানোর ইতিহাস খুবই হতাশাজনক। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ায় গণহত্যা স্বীকার করতে দেরি করেছে তারা। রুয়ান্ডায় শান্তিরক্ষী কমান্ডার রোমিও ডালেয়ার আগেই সতর্ক করেছিলেন কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এখন গাজার অবস্থা ভয়াবহ। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলের আক্রমণে অন্তত ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। পুরো গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, এই ধ্বংস নতুন রিয়েল এস্টেট উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করছে।
গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের শীর্ষ তদন্ত সংস্থা ঘোষণা দিয়েছে—গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা করেছে। এটিই সবচেয়ে স্পষ্ট ও কর্তৃত্বপূর্ণ রায়। গণহত্যা বিশেষজ্ঞ মার্টিন শ’র মতে, এটি আধুনিক ইতিহাসের অন্যান্য গণহত্যার থেকে আলাদা। তাঁর মতে, গাজার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ দেরি করছে না স্বীকৃতিতে বরং সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ—অস্ত্র সরবরাহ ও রাজনৈতিক সমর্থনের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘ ব্যর্থ নয়, ব্যর্থ সদস্য রাষ্ট্রগুলো। বড় শক্তিধর দেশগুলো সাধারণত বিদেশে হস্তক্ষেপে অনিচ্ছুক। যেমন ২০০০-এর দশকে দারফুরে হত্যাযজ্ঞের সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে গণহত্যা স্বীকার করেছিল কিন্তু পরে আগ্রহ হারায়। আফ্রিকান ইউনিয়ন তখন সামান্য কিছু শান্তিরক্ষী পাঠায়। জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিক মিশন অনুমোদন দেয় ২০০৬ সালে, যখন হত্যাযজ্ঞ প্রায় শেষ।
শান্তিরক্ষা বিশেষজ্ঞ আলেক্সান্দ্রা নোভোসেলফ বলেন, জাতিসংঘের হাতে নানা বিকল্প আছে—নিষেধাজ্ঞা, শান্তিরক্ষী বাহিনী বা ইচ্ছুক দেশগুলো নিয়ে জোট তৈরি। কিন্তু সদস্য রাষ্ট্রগুলো একমত না হলে কিছুই হয় না। গাজায়ও সেটাই ঘটছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো হুমকি কার্যকর উদ্যোগকে আটকে দিচ্ছে।
আগামী সপ্তাহে সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন প্রশ্নে বড় আলোচনা হবে। ফ্রান্স ও সৌদি আরব চাইছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিক। তবে সাধারণ পরিষদ এখনো বিভক্ত।
ইতিহাস বলছে, বড় শক্তিধর দেশের সামরিক পদক্ষেপ ছাড়া গণহত্যায় কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেওয়া কঠিন। বসনিয়ায়ও দেখা গেছে, জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে হস্তক্ষেপ করে।
কাটো ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ডগ ব্যান্ডো বলেন, গাজায় দায় জাতিসংঘের নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের। তাঁর ভাষায়, জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। রুয়ান্ডা, সুদান, লাইবেরিয়া—কোথাও তারা গণহত্যা ঠেকাতে পারেনি। তাই গাজাতেও পারবে না। ব্যান্ডোর মতে, ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখছে যুক্তরাষ্ট্র, আর জাতিসংঘকে কার্যকর হতে দিচ্ছে না।

