কাতারে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার পর আরব উপসাগরের দেশগুলোতে প্রতিক্রিয়া তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির পর ‘আরব ন্যাটো’ বা ‘মুসলিম ন্যাটো’ ধারণা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। যদিও অতীতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের পথে অনেক জটিলতা ও অভ্যন্তরীণ বিভাজনের কারণে সফল হয়নি।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবের পর কাতারে আলোচনায় বসেন হামাসের নেতারা। এ সময় দোহার আবাসিক এলাকায় হামাস নেতাদের ভবনে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়। আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী এবং আতঙ্কিত দোহার চিত্র প্রকাশ করে যে, পরিস্থিতি কতটা সংবেদনশীল ছিল।
৯ সেপ্টেম্বরের হামলায় কাতারে অবস্থানরত হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে যান। তবে নিহত হন হামাসের শীর্ষ নেতা খলিল আল-হায়ার ছেলেসহ পাঁচজন। নিহতদের মধ্যে একজন কাতারের নিরাপত্তাকর্মী এবং বাকিরা হামাস নেতাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন।
ইসরায়েলের এই হামলার পর নড়েচড়ে বসে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতারের কৌশলগত সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের ‘স্পর্ধা’ সহ্য করা কঠিন হয়ে ওঠে। হামলার আগে ইসরায়েল বিষয়টি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জানিয়েছে এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আরব নেতারা বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনা করতে শুরু করেছেন, এমন গুঞ্জন উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
১৫ সেপ্টেম্বর কাতারে ইসরায়েলের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা (জিসিসি) জরুরি সম্মেলন আহ্বান করে। এতে প্রায় ৬০ দেশের নেতা ও কর্মকর্তারা অংশ নেন। অধিকাংশ নেতা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। এ আলোচনার প্রেক্ষিতে ন্যাটোর আদলে ‘আরব ন্যাটো’ বা ‘মুসলিম ন্যাটো’ ধারণা আবার সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।
মিসরের সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল নিউজ জানিয়েছে, কাতারে হামলার প্রেক্ষাপটে মিসর ‘আরব সামরিক জোট’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া ওআইসির সম্মেলনে ইরাকও ‘মুসলিম ন্যাটো’ গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছে।
১৯ সেপ্টেম্বর জিসিসি জোটের যৌথ প্রতিরক্ষা কাউন্সিল দোহায় এক বিশেষ অধিবেশনে সম্মত হয় যে, যেকোনো বিদেশি হামলার বিরুদ্ধে তারা প্রতিরক্ষামূলক যৌথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব ও পাকিস্তান ১৭ সেপ্টেম্বর ‘কৌশলগত যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি’ স্বাক্ষর করলে ‘আরব ন্যাটো’ বা ‘মুসলিম ন্যাটো’ ধারণা আরও জোর পেয়েছে।
আরব ন্যাটো ধারণার ইতিহাস-
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সদস্যদেশ হামলার শিকার হলে, সেটিকে সব সদস্য দেশের ওপর হামলা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সকলেই যৌথভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। মূলত ইউরোপ ভিত্তিক এই জোটে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ছাড়া প্রায় সব দেশই ইউরোপের।
কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর ন্যাটোর আদলে ‘আরব ন্যাটো’ বা ‘মুসলিম ন্যাটো’ ধারণা পুনরায় আলোচনায় এসেছে। মিসর এবং ইরাকের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি উত্থাপনের মাধ্যমে এ ধরনের জোট গঠনের সম্ভাবনা আবারও জোরদার হয়েছে। তবে বাস্তবতায় সামরিক জোট গঠন আরব দেশগুলোর মধ্যে সরল বা সোজাসাপ্টা হবে না। দেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে এই উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হবে।
২০১৫ সালে মিসর প্রথমবারের মতো শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত আরব শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটো ধাঁচের সামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেয়। নীতিগতভাবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়, তবে পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয় না। প্রধান কারণ ছিল, জোটের কমান্ড কাঠামো এবং সদর দপ্তর কোথায় হবে, তা নিয়ে সদস্যদের মধ্যে মতবৈষম্য।
সেই সময় ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের বড় অংশ দখল করলে মিসর খসড়া আকারে প্রস্তাবটি দিয়েছিল। যদিও ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের পক্ষে লড়াই করার জন্য সৌদি নেতৃত্বে একটি জোট গঠন করা হয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাব-
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নিজ সরকারের সময়ে ইরানকে লক্ষ্য করে আরব সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে রয়টার্স জানিয়েছিল, ট্রাম্প প্রশাসন গোপনে একটি নতুন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে। এতে ছয়টি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র, মিসর ও জর্ডানকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য ছিল। জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কমানো।
হোয়াইট হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, সামরিক প্রশিক্ষণ, সন্ত্রাস দমন এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতায় একত্র করার ওপর জোর দেওয়া হবে। এই পরিকল্পনাকে তখন ‘আরব ন্যাটো’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
জিসিসির ভূমিকা-
জিসিসি ২০০০ সালে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তিতে বলা হয়, কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর হামলা মানেই সব সদস্যের ওপর হামলা। সাম্প্রতিক সময়ে জিসিসি ঘোষণা করেছে, তারা কাতারের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব ধরনের সক্ষমতা কাজে লাগাতে প্রস্তুত। তবে এই প্রতিশ্রুতি ন্যাটোর মতো সুসংগঠিত নয়। কারণ, জোটের কোনো সমন্বিত সামরিক কমান্ড কাঠামো নেই। অতীতে হুতিদের হামলার সময়ও জিসিসি যৌথভাবে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়নি।
আঞ্চলিক উদ্বেগ-
উপসাগরীয় নেতারা লেবানন, সিরিয়া ও ইরানের প্রতি ইসরায়েলের সম্ভাব্য আগ্রাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন। এছাড়া গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঔদাসীন্য জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছে। ফলে উপসাগরীয় দেশগুলো বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুঁজতে শুরু করেছে।
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির পর বহুপক্ষীয় সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা বেড়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার উল্লেখ করেছেন, আরো কিছু দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহী। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারও এ ধরনের চুক্তিতে যুক্ত হতে পারে।
ইসরায়েলের ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ বাস্তবায়নের হুমকি ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানের ভূখণ্ডকে লক্ষ্য করছে। এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলো সরাসরি হুমকির মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্রের জায়নবাদী খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর সমর্থন ছাড়া আরবদের পাশে সরাসরি দাঁড়ানো কঠিন। ফলে বিকল্প জোটের ধারণা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা-
সর্বদা যেমন হয়েছে, সামরিক জোট গঠন সহজ হবে না। আরব দেশগুলোর মধ্যে ভিন্ন স্বার্থ, জিওপলিটিকাল আধিপত্য এবং পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা যেমন ২০১৫ সালের প্রস্তাবের ব্যর্থতা ইঙ্গিত দেয়। তুরস্ককে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না বেশিরভাগ আরব দেশ। এছাড়া ২০১৭ সালে সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ ছয়টি দেশের কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করার ঘটনায় জোটে একতা কমে গেছে।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ জানিয়েছে, কাতারে হামলার পর দোহায় ছুটে যান আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ। যদিও কাতারের আমিরের অনুরোধে ইসরায়েলের দূতাবাস বন্ধ করা হয়নি। এই ঘটনার পর ‘আরব ন্যাটো’ বা ‘মুসলিম ন্যাটো’ ধারণা আবার নতুন আলোচনায় এসেছে। তবে দেশগুলোর স্বার্থের ভিন্নতা এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কারণে কার্যকর জোট গঠন সহজ হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট আই, রয়টার্স, আরব নিউজ, ডন। অনুবাদে: এফ.আর. ইমরান।