নেপালে চলতি মাসে দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করেছে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি গৌরী বাহাদুর কার্কি।
বার্তাসংস্থা রয়টার্স অনুসারে, নেপালের অর্থমন্ত্রী রামেশ্বর খানাল জানিয়েছেন, কমিটি বিক্ষোভ চলাকালীন প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, উভয় পক্ষের বাড়াবাড়ি এবং অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় কারা জড়িত ছিল তা খতিয়ে দেখবে।
চলতি মাসে নেপালে দুর্নীতি, চাকরির অভাব এবং অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক জনআন্দোলন দেখা দেয়। জেনারেশন জেড বা জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দ্রুত সহিংসতায় রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান তোলার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্থাপনা, আদালত ভবন এবং বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষোভ উগরে দেয়।
রাজধানী কাঠমান্ডুতে আন্দোলনের সময় সুপ্রিম কোর্ট, পার্লামেন্ট ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করা হয়। পাশাপাশি অসংখ্য শপিং মল, হোটেল এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন শোরুমে আগুন দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীদের দৃষ্টিতে এগুলো দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের প্রতীকী ঠিকানা। পুলিশি বাধা, কাঁদানে গ্যাস এবং গুলির ব্যবহারের পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত অন্তত ৭৪ জন মারা গেছেন এবং দুই হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে, যার মধ্যে প্রধান সদস্য হিসেবে আছেন গৌরী বাহাদুর কার্কি। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটি প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভে সহিংসতার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার সরকার কখনো পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়নি। ওলি আরও জানিয়েছেন, আন্দোলনের মধ্যে ‘বাইরের লোকজন’ ঢুকে পড়ে এবং যারা ভিড়ের দিকে গুলি চালিয়েছে, তাদের কাছে এমন অস্ত্র ছিল যা পুলিশের কাছে ছিল না। তিনি বিশ্বাস করেন, এ ঘটনার নেপথ্যে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে এবং প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন জরুরি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নেপালের বর্তমান অস্থিরতার মূল কারণ দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা জন-অসন্তোষ। দুর্নীতি, বেকারত্ব, শিক্ষিত যুব সমাজের কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনীতিতে স্বজনপ্রীতি এবং সামাজিক অবিচারের কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। জেন-জি প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে আন্দোলন দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
সরকার আশ্বাস দিয়েছে, সহিংসতার দায় প্রমাণিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ও দাবিগুলো শোনার জন্যও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কির মন্ত্রিসভায় চারজন নতুন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেছেন। রাজধানী কাঠমান্ডুর প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন শীতল নিবাসে প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেল তাদের শপথ পাঠ করান। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী কার্কি, স্পিকার দেবরাজ ঘিমিরে এবং জাতীয় পরিষদের চেয়ারম্যান নারায়ণ প্রসাদ দহল।
নতুন শপথ নেওয়া চারজন মন্ত্রীর নাম ও দায়িত্ব হলো:
- অনিল কুমার সিনহা – শিল্প, আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়
- মহাবীর পুন – শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়
- জগদীশ খারেল – তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়
- ড. মদন পরিয়া – কৃষি ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়
এমতাবস্থায় মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা এখন আট। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রস্তাবিত ড. সঙ্গীতা কৌশল মিশ্রার শপথ শেষ মুহূর্তে স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
নেপালের অন্তর্বর্তী সরকার এবং বিচার বিভাগীয় কমিটি আশা করছে, এই পদক্ষেপ দেশের অস্থির পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে এবং ভবিষ্যতে জনসংহতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান আনতে সাহায্য করবে।

