জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক ঐতিহাসিক ঘোষণায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি যুদ্ধ-পরবর্তী গাজায় একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা অনেক দেশের সমর্থন পেলেও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে।
ম্যাক্রোঁ বলেন, “গাজায় যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ এবং রক্তপাত শেষ করার সময় এসেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। তাই গাজা, পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমসহ পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি।”
এই ঘোষণায় জাতিসংঘের হলরুমে করতালি ও দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানানো হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একে “ঐতিহাসিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত” বলে আখ্যা দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বৈঠকে উপস্থিত ছিল না এবং তাদের কর্মকর্তারা ফরাসি উদ্যোগকে সরাসরি বাতিল করে দেন।
ইউরোপে স্বীকৃতির ঢেউ
ম্যাক্রোঁর ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মোনাকো, বেলজিয়াম, আন্দোরা, মাল্টা ও লুক্সেমবার্গও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে জাতিসংঘের তিন-চতুর্থাংশ সদস্য এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াও অনুরূপ সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ সাধারণ পরিষদে বলেন, “এটি কেবল সূচনা, এখনই শেষ নয়। ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ দিতে হবে।”
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জোর দিয়ে বলেন, “রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কোনো পুরস্কার নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের অধিকার।” একই সঙ্গে তিনি হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলাকে নৃশংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে নিন্দা করেন, তবে ইসরায়েলের সমষ্টিগত শাস্তির নীতিকেও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন।
ইসরায়েলের হুমকি ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
ইসরায়েলের জাতিসংঘ দূত ড্যানি ড্যানন পুরো অধিবেশনকে “রাজনৈতিক সার্কাস” বলে বিদ্রুপ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দিয়েছে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির জবাবে ইসরায়েল বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। ইতোমধ্যেই ইসরায়েল পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার হুমকি দিয়েছে।
গুতেরেস বলেন, “অবিরাম বসতি স্থাপন, সংযুক্তিকরণের হুমকি, দখলদারদের সহিংসতা—সবকিছুই থামাতে হবে। এগুলোই দুই রাষ্ট্র সমাধানকে ধ্বংস করছে।”
গাজায় শান্তিরক্ষা বাহিনী নিয়ে আলোচনা
ফরাসি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, একটি জাতিসংঘ অনুমোদিত আন্তর্জাতিক বাহিনী গাজায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, হামাসকে নিরস্ত্র করবে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে নতুন পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে। আরব লীগও জানিয়েছে, ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি শাসনে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না।
কিন্তু এদিকে ইসরায়েল একই দিনে গাজা সিটিতে তীব্র অভিযান চালায়। কেবল সোমবারেই অন্তত ৩৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৩০ জন গাজা সিটিতেই। ইসরায়েল দাবি করছে, শহরে প্রায় তিন হাজার হামাস যোদ্ধা লুকিয়ে আছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে আরব নেতাদের বৈঠক
ফরাসি উদ্যোগের সমান্তরালে নিউইয়র্কে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতারা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লক্ষ্য, গাজায় ভবিষ্যৎ শান্তিরক্ষা বাহিনী নিয়ে আরেকটি রূপরেখা তৈরি করা।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্প মঙ্গলবার জাতিসংঘে ভাষণ দেবেন, যেখানে তিনি “গ্লোবালিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যবস্থা ধ্বংস করেছে” বলে অভিযোগ করবেন। এরপর তিনি তুরস্ক, সৌদি আরব, মিশর, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
তবে ট্রাম্প এখনো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে হামাসের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নন। বরং তিনি আবু মাজেন (মাহমুদ আব্বাস)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন এবং নিউইয়র্কে আসতে বাধা দিয়েছেন। ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আব্বাস বলেন, “আমরা ১৪৯টি দেশকে ধন্যবাদ জানাই যারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। হামাসকেও অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে।”
ইউরোপ-আরবের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভেট কুপার সতর্ক করেছেন, নতুন স্বীকৃতির জবাবে যদি ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখলের দিকে এগোয় তবে পুরো শান্তি প্রক্রিয়া ভেঙে পড়বে। তিনি বলেন, “দুই রাষ্ট্র সমাধান ধ্বংস করতে চায় উভয় দিকের উগ্রপন্থীরা।”
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োহান ওয়াডেফুল বলেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি হয়তো এখনো শেষ ধাপ, তবে এই প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা জরুরি।
সংযুক্ত আরব আমিরাতও জানিয়েছে, ইসরায়েল যদি দখলদারি বাড়ায় তবে তা আব্রাহাম চুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তবে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেয়নি, বরং বলেছে এতে আঞ্চলিক একীভূতকরণের ভবিষ্যৎ থমকে যাবে।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল বারো স্পষ্ট করে বলেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হামাসকে অস্বীকার করা, কারণ এই পরিকল্পনায় হামাসকে সম্পূর্ণভাবে ভবিষ্যৎ শাসন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সবশেষে, জাতিসংঘের ৮০তম বার্ষিকীতে এই নাটকীয় পালাবদল দেখিয়েছে—ফিলিস্তিন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অঙ্গন নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। একদিকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দ্রুত বাড়ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের দখলনীতি ও হামাসকে ঘিরে বিরোধ আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

