জাতিসংঘ ফিলিস্তিন সম্মেলন→
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানের জন্য দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান কার্যকর করার উদ্যোগে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনকে ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে, বিশেষ করে ফ্রান্সের প্রতি জোরালো ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ব্যবহার করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও শীর্ষ কর্মকর্তারা সম্মেলন নিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে লুকোছাপা করেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সম্মেলনকে ‘প্রতীকী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এটি হামাসকে ‘সাহস জোগানোর’ একটি পদক্ষেপ মাত্র। ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি এক ধাপ এগিয়ে সম্মেলনকে ‘ঘৃণ্য’ আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ফ্রান্সকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য ‘ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা’ ছাড়তে বলার মতো ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যও করেছেন।
এই সম্মেলনের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ফ্রান্সকে আক্রমণ করতে কোনো দ্বিধা দেখায়নি, কিন্তু সৌদি আরবের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে নীরব থেকেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প সৌদি আরবকে রাগাচ্ছেন না। এটি প্রতিফলিত করছে যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব, গাজার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ধারণার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

মিডল ইস্ট আই অনুসারে, কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ফ্রান্সকে আক্রমণ করে সৌদি আরবকে ছাড় দেওয়ার পেছনে মূলত রিয়াদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি কাজ করছে। সৌদি আরবের আর্থিক বিনিয়োগ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে প্রভাবই এই দ্বৈত নীতির কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক বাদের আল-সাইফ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন নীরবে দেখিয়েছে যে তারা ফিলিস্তিন বিষয়ে তাদের ঘনিষ্ঠ আরব মিত্রদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে চায় না।
গত সোমবার জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর বক্তব্যে উপস্থিত নেতারা দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ফ্রান্স এই সম্মেলনে উচ্চপর্যায়ের অবস্থান নিয়েছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান উপস্থিত না থাকলেও- পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান তাঁর পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেছেন।
ট্রাম্প গত মে মাসে সৌদি আরবে এক ঐতিহাসিক সফর করেন। সফরে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে তাঁর প্রশাসন বৈদেশিক সংঘাতে কম হস্তক্ষেপ করবে। সফরের সময় সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই সফরের প্রভাব মিশ্র—কিছু ক্ষেত্রে ভালো ফল হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে হয়নি। সৌদি আরবের চাপের কারণে ট্রাম্প ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা বন্ধ করেছেন, যদিও হুতিরা এখনও ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে। একইভাবে, তিনি সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন।

তবে ফিলিস্তিনের গাজার বিষয়ে ট্রাম্প কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তিনি ইসরায়েলের ওপর নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছেন। জাতিসংঘ, ইতিহাসবিদ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা এই সমর্থনকে জাতিগত হত্যার সমান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইসরায়েলের গণহত্যা সম্পর্কে বক্তব্য দিলেও, ট্রাম্প নীরব থেকেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বৈত নীতি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে এসেছে। গ্রেগরি গস, ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ- বলেন, ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। তবে গালফের দেশগুলো তার মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং ইউরোপের তুলনায় বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।
ফ্রান্সের সমালোচনা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ। এতে ঝুঁকি কম। অন্যদিকে, সৌদি আরবের সমালোচনা করা কঠিন। গালফের এই মিত্র দেশের জনগণ গাজার ইস্যুতে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এছাড়া সৌদি আরব–যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং এআই চিপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি চুক্তি বিবেচনায় নিলে, প্রকাশ্যে কোনো সমালোচনা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

ফ্রান্স ন্যাটোর সদস্য। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় উপস্থিতি চাইছে এবং সেই কারণে সম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করছে। সৌদি আরব ন্যাটোর অংশ নয়। তাই তারা তুলনামূলকভাবে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সিরিয়া, লেবানন ও ইরানের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন সৌদি আরব ও গালফের দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করেছে।
গ্রেগরি গস আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছে। চীনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এ প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবকে পাশে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্স ন্যাটো ছেড়েও গেলে, এই অঞ্চলের কোনো কারও তেমন মাথাব্যথা হবে না।
ফলস্বরূপ, জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনে ফ্রান্সকে কঠোরভাবে সমালোচনা করলেও, সৌদি আরবকে আক্রমণ থেকে ট্রাম্প প্রশাসন বিরত থাকে। এ দ্বৈত নীতি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

