খড়গপুরের আইআইটির চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র স্বপ্নিল চক্রবর্তী (নাম পরিবর্তিত) মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। তাঁর মতো বহু ব্যাচমেটের লক্ষ্য ছিল—গ্র্যাজুয়েশনের পরই বড় কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে উচ্চ বেতনে আমেরিকায় কর্মজীবন শুরু করা। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক একটি প্রোক্ল্যামেশন এই স্বপ্নকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে বাধাগ্রস্ত করেছে।
স্বপ্নিল ফোনে জানালেন, “আমাদের ব্যাচের অনেকেই এখন আর গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা যাওয়ার চিন্তা করছে না। তবে আমি সবসময় চাইতাম আইআইটি থেকে পাশ করে কয়েক বছর মার্কিন পরিবেশে কাটাতে।” ভারতের প্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষার উদাহরণ কম নয়।
নতুন এইচ-ওয়ানবি ভিসা নীতির প্রভাব-
ট্রাম্প প্রশাসনের এইচ-ওয়ানবি (H-1B) ভিসার নতুন নিয়ম ভারতীয় তরুণদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এই ভিসার ফি লাফিয়ে বেড়ে ১ লাখ ডলার হয়েছে। এর আগে ফি মাত্র ২০০০ থেকে ৫০০০ ডলার ছিল। নতুন ফি এমনকি এইচ-ওয়ানবি ভিসাধারীদের বার্ষিক গড় বেতনের চেয়ে অনেক বেশি।

এই উচ্চ ফি কোনো কোম্পানি সহজে বহন করতে চায় না। ব্যতিক্রমী দক্ষতা বা মেধা না থাকলে কোনো বিদেশি পেশাজীবী এত খরচের বিনিময়ে আমেরিকায় কাজের সুযোগ পাবে না। ভারতীয় নাগরিকরা সর্বাধিক প্রভাবিত হবেন—কারণ প্রতি বছর এইচ-ওয়ানবি ভিসার ৭০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় নাগরিক পান।
গত আর্থিক বছরে ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জন ভারতীয় ছিলেন এইচ-ওয়ানবি ভিসাপ্রাপক। তুলনামূলকভাবে চীনা নাগরিক মাত্র ১১.৭ শতাংশ। অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সংখ্যাও ভারতের তুলনায় অনেক কম। তাই নতুন ভিসা ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ভারতের প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস (TCS) বা ইনফোসিসের মতো ভারতীয় কোম্পানিও এই ভিসার বড় গ্রাহক। মার্কিন সিটিজেনশিপ ও ইমিগ্রেশন সার্ভিসেসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছরের জুন পর্যন্ত ১ লাখ ৭ হাজার এইচ-ওয়ানবি ভিসা মঞ্জুর হয়েছে, যার ১৩ শতাংশ ভারতের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য। নতুন নীতি এই রেওয়াজকে অনিশ্চিত করে দেবে।
ফি বৃদ্ধির বিশদ-
প্রথমে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক ঘোষণা করেছিলেন, তিন বছর মেয়াদী প্রতিটি এইচ-ওয়ানবি ভিসার জন্য কোম্পানিকে প্রতি বছর ১ লাখ ডলার দিতে হবে। পরে মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে এটি ‘এককালীন পেমেন্ট’। মেডিক্যাল খাতে যারা এইচ-ওয়ানবি ভিসায় আসবেন, তারা চড়া ফি থেকে মুক্ত থাকবেন। তবে এ সিদ্ধান্ত স্বপ্নিলের মতো ভারতীয় প্রযুক্তি ও ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েটদের জন্য তেমন সুরাহা বয়ে আনে না।

স্বপ্নিল জানান, “এখন আপাতত দেশেই চাকরি খুঁজব। আমেরিকার দরজা বন্ধ থাকলে ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়ার ভাবনা নেই।” সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয়রা অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প কার্যত এইচ-ওয়ানবি ভিসার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন, যার ফলে নতুন প্রজন্মের জন্য ‘আমেরিকান ড্রিম’ বিপন্ন।
প্রভাব পড়ার সম্ভাব্য ক্ষেত্র-
আইআইটির অধ্যাপক ও প্রাক্তন ছাত্র ড: সৌম্য জানা মনে করিয়ে দেন, কয়েক বছর আগে গ্র্যাজুয়েটদের আমেরিকায় যাওয়ার ক্রেজ ছিল অত্যধিক, এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। ড: জানা বলেন, “বর্তমানে ভারতীয়রা চাইলে তাদের কেরিয়ারকে মার্কিন বাজারের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে, তবে সরাসরি আমেরিকায় কাজ করার তাগিদ নেই। তাই নতুন ভিসা নিয়ম খুব বড় প্রভাব ফেলবে না।”
কানপুর আইআইটির প্রাক্তন ছাত্র অজয় কুমার কয়াল বলেন, “ভারতীয়দের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি অন্ধকারময় মনে হলেও অতিরিক্ত আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমেরিকার ইমিগ্রেশন নীতি ইতিহাসে নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে গেছে—এটি স্থায়ী নয়।”
আইটি ও প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রাক্তনরা মনে করছেন, নতুন নীতি সংক্ষেপে কিছু প্রতিকূলতা তৈরি করবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে বাজার নিজেই সামঞ্জস্য বজায় রাখবে।

শিল্প ও অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব-
খড়্গপুর আইআইটির প্রাক্তন ছাত্র ও ভারতীয়-আমেরিকান উদ্যোগী বিপ্লব পাল সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “যে শহরগুলোতে ভারতীয়রা আইটি শিল্পে কাজ করছে—যেমন পুনে, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ—তাদের উন্নয়ন মূলত এইচ-ওয়ানবি ভিসার ওপর নির্ভরশীল। ভিসা বন্ধ হলে দেশীয় চাকরির বাজারেও প্রভাব পড়বে।”
তিনি আরো বলেন, “ভিসা থাকলে ভারতীয়রা আমেরিকায় কাজের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে এবং দেশে কোম্পানি স্থাপন করে। বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে, যা ভারতের ফরেন রিজার্ভের বড় উৎস।” এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, ভিসা নীতির পরিবর্তন শুধু ব্যক্তিগত স্বপ্ন নয়, ভারতের অর্থনীতি ও প্রযুক্তি শিল্পেও প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারতীয় প্রতিক্রিয়া-
নতুন নীতি ঘোষণার পর ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় উদ্বেগের ঢেউ দেখা দিয়েছে। এক্স ও ফেসবুকে অনেকেই ‘আমেরিকান ড্রিম ভেঙে গেছে’ বলছেন। ‘মুম্বাই নাওকাস্ট’ হ্যান্ডলটি মন্তব্য করেছে, “ট্রাম্প এইচ-ওয়ানবি ভিসাকে খুন করে দিয়েছেন।”
আরেকজন ব্যবহারকারী ‘ডি’ লিখেছেন, “যদি ৫০ হাজার ভারতীয় প্রযুক্তি কর্মী দেশে ফিরেন, তাদের মধ্যে ৪৯ হাজার চাকরি খুঁজতে ঝাঁপাবে। দেশের বাজারে ইতিমধ্যেই মন্দা চলছে। অনেক কোম্পানি পুরনো কর্মীদের ছাঁটাই করে নতুনদের নিতে চাইবে। এটি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য বড় সংকট।”
নীতিন ভাটিয়া মন্তব্য করেছেন, “আমেরিকান স্বপ্ন শেষ, ভারতের আইটি শিল্পে সূর্যাস্ত শুরু।” অরুণ অরোরা জানান, “এইচ-ওয়ানবি ভিসা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে প্যানিক সত্যিই আছে।”
টেলুগুভাষী ‘উদয়’ লিখেছেন, “যারা ৪০–৫০ লাখ রুপি ধার নিয়ে আমেরিকায় পড়েছে, তারা এখন ভারতে ফিরে ঋণগ্রস্ত হতে চলেছে। এই ভিসার কারণে তাদের স্বপ্নই ভেঙে গেছে।”

ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া ও উদ্যোগ-
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিল, নতুন নীতি ‘সম্ভাব্য মানবিক পরিণাম’ বয়ে আনবে। ২০–২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভারতীয় কর্মকর্তারা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন এবং অস্পষ্টতা দূর করার চেষ্টা করেছেন।
মার্কিন প্রশাসন পরে নিশ্চিত করেছে, ১ লাখ ডলারের ফি কেবল নতুন ভিসার জন্য প্রযোজ্য, নবায়ন বা বর্তমান ভিসাধারীরা এ ফি দিতে হবেন না। তবে ভারত সরকার তরুণদের সতর্ক করার বার্তাও দিচ্ছে—সব সময় সহজে এইচ-ওয়ানবি ভিসায় নির্ভর করা উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রী মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সঞ্জীব সান্যাল যুক্তি দিয়েছেন, “এইচ-ওয়ানবি মূলত আমেরিকার সুবিধার জন্য, ভারতীয় কোম্পানিগুলোর নয়। অ্যামাজন ও গুগল জাতীয় টেক জায়ান্টরা বেশি ব্যবহার করে। তাই ভারতের তরুণদের আমেরিকায় যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
ড: জানা ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতীয়রা এখন মূলত মার্কিন বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছে, সরাসরি সশরীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই পরিস্থিতি ভারতীয় তরুণদের জন্য অস্থায়ী চ্যালেঞ্জ হলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব সীমিত হবে।

পরিশেষে, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন এইচ-ওয়ানবি ভিসা নীতি ভারতের তরুণ প্রযুক্তি ও ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েটদের স্বপ্নে প্রাথমিক আঘাত করেছে। ভারতের আইটি খাত, শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আতঙ্ক ও প্যানিক লক্ষ্য করা গেছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি স্থায়ী প্রভাব নয়। ভারতীয় তরুণরা অন্যান্য মার্কিন বা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে কেরিয়ার এগিয়ে নেবে।
তবে স্বপ্নিল চক্রবর্তী ও তাঁর মতো নতুন প্রজন্মের জন্য এখন সময় সীমিত। তাদের পরিকল্পনা এখন দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে এসেছে। ভারত সরকার ও মার্কিন প্রশাসনের পরবর্তী আলোচনার ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে—কতটা স্বপ্ন পূরণ হবে, আর কতটা নতুন বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে হবে তরুণদের।

