আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের উপকণ্ঠে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি আবারো আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এ ঘাঁটিটি ফের যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসা উচিত। তাঁর দাবি, ঘাঁটিটির অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে ওয়াশিংটন, তাই এটি যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরত দিতে হবে।
তবে আফগানিস্তানের বর্তমান বাস্তবতায় এই দাবি বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
অতীতের প্রেক্ষাপট-
২০২১ সালে তালেবান যোদ্ধারা যখন চারদিক থেকে কাবুল ঘিরে ফেলে, তখন মার্কিন সেনারা হঠাৎ করেই বাগরাম ঘাঁটি ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। ওই মুহূর্তটি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ২০ বছরের উপস্থিতির অবসানকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। সেখান থেকে তালেবানের ক্ষমতা কায়েম হয় এবং মার্কিন প্রভাব কার্যত বিলীন হয়ে যায়।
এই ঘটনার চার বছর পর আবারও বাগরাম ঘাঁটির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, যদি আফগানিস্তান ঘাঁটিটি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে না তুলে দেয় তাহলে ‘খারাপ কিছু ঘটবে’। তাঁর এ বক্তব্য নতুন এক অস্থিরতা তৈরি করেছে।
কুগেলম্যানের সতর্কতা-
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিষয়টি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্পের বক্তব্য কোনো কূটনৈতিক ভণিতা নয়। বরং তিনি সত্যিই বাগরাম ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ ফের চাইছেন।
কুগেলম্যানের মতে, এ কারণে দুইটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে—যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ঘাঁটি দখল করে নেবে অথবা সেটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দুই ক্ষেত্রেই ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে এবং পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
তাঁর সতর্কবাণী অনুযায়ী, এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে মার্কিন ও আফগান উভয় পক্ষেই অনেক প্রাণহানি ঘটতে পারে। যা ভবিষ্যতের জন্য আরো সংকট তৈরি করবে।
তালেবানের অবস্থান-
তালেবান সরকার বাগরাম ঘাঁটি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনার সম্ভাবনা একেবারেই নাকচ করে দিয়েছে। গত রোববার এক বিবৃতিতে তারা জানায়, আফগানিস্তানে কোনো বিদেশি সেনার উপস্থিতি তারা মেনে নেবে না। যদিও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় বন্দি বিনিময় আলোচনায় তারা আগ্রহী, তবে বাগরাম ঘাঁটি নিয়ে আপস করার প্রশ্নই আসে না।
কুগেলম্যানও বলেছেন, তালেবান সরকারের কাছে বাগরাম একটি “রেড লাইন”—এটি তারা কোনো অবস্থাতেই ছাড়তে চাইবে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি চাপ প্রয়োগ করে, তা নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে বাধ্য।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা-
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই বাগরাম ঘাঁটি দখল করতে চায়, তবে এর প্রভাব শুধু আফগানিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। চীন এ পদক্ষেপকে উসকানিমূলক হিসেবে দেখবে এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাবে।
কুগেলম্যান তাঁর মন্তব্যে বলেন, ওয়াশিংটন আসলে বাগরাম ব্যবহার করে ইসলামিক স্টেট খোরাসানকে মোকাবিলা করতে চায়। তবে তিনি মনে করিয়ে দেন, সন্ত্রাসবাদ প্রতিহত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোথাও উদ্যোগ নেওয়া উচিত, কারণ বাগরামের মতো স্পর্শকাতর জায়গা দখল করলে ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে।
সীমিত যোগাযোগ ও সম্ভাবনা-
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের মধ্যে যোগাযোগ অত্যন্ত সীমিত। তবুও এই স্বল্প যোগাযোগকেই বিশ্লেষকরা মূল্যবান বলে মনে করেন। কারণ এই সম্পর্ক বজায় থাকলে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে উভয় পক্ষ কোনো না কোনোভাবে সহযোগিতা করতে পারবে।
তবে যদি বাগরাম ঘাঁটি নিয়ে জটিলতা চরমে পৌঁছায়, তবে এই সীমিত সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এতে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দুই দেশের যৌথ প্রচেষ্টা ভেঙে পড়বে এবং আফগানিস্তান আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
পরিশেষে, বাগরাম ঘাঁটি এখন কেবল একটি সামরিক ঘাঁটি নয়, বরং আন্তর্জাতিক শক্তি-প্রদর্শনের প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্য ঘিরে এর ভবিষ্যৎ আবারো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একদিকে তালেবানের অস্বীকৃতি, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ—দুইয়ের সংঘাতে কেবল আফগানিস্তান নয়, সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
কুগেলম্যানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ট্রাম্প সত্যিই এ ঘাঁটি পুনর্দখল করতে চাইলে তা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করবে। ফলে এখন প্রশ্ন একটাই—ওয়াশিংটন কি এই দ্বন্দ্বময় পথ বেছে নেবে, নাকি সীমিত যোগাযোগ বজায় রেখে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেবে?

