বাংলার মানুষের কাছে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বলতে সাধারণত শোষণের পাকাপোক্ত ব্যবস্থাকেই বোঝায়। ১৭৯৩ সালে দখলদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক লর্ড কর্নওয়ালিস এই অঞ্চলে ব্রিটিশ দখলদারিত্বকে স্থায়ী রূপ দিতেই জমির ওপর ইংরেজভক্ত জমিদারদের নিরঙ্কুশ মালিকানার ব্যবস্থা করেন। ইতিহাসের পরিক্রমায় সেই পুরোনো ব্যবস্থার আধুনিক রূপ কি দেখতে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা?
ইতিহাসবিদদের অনেকে মনে করেন—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নীতিনির্ধারকরা শুধুমাত্র রাজস্ব আহরণের জন্যই এই অঞ্চলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রচলন করেননি, তারা তাদের দখলদারিত্বকে স্থায়ী করতে প্রশাসন, বিচার ও পুলিশ বিভাগকে নিজেদের কাজে লাগানোর কৌশল হিসেবে এটি প্রবর্তন করেছিলেন।
এবার আসা যাক আলোচ্য বিষয়ে। সবাই জানেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ দায়িত্বে গাজা যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন। তা করতে তিনি ২০-দফা প্রস্তাবও দিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে তিনি ‘যুদ্ধ বন্ধ করো’ বললেই যেখানে যুদ্ধ বন্ধ হয়, সেখানে তার দীর্ঘ ২০-দফার ‘ফুলঝুরি’ ঠিক কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের মনে।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়—গত ২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার শান্তি প্রস্তাব প্রকাশ করেন। এর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও যুদ্ধাপরাধী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নেতানিয়াহু তার পছন্দ মাফিক প্রস্তাবগুলো সম্পাদনার সুযোগ পান। অর্থাৎ, ট্রাম্প তার প্রস্তাব নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর তা চাপিয়ে দেন ফিলিস্তিনি তথা বিপর্যস্ত গাজাবাসীর ওপর।
শুধু তাই নয়, ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছেন ‘তিন/চার দিনের মধ্যে হামাস তার প্রস্তাব মেনে না নিলে নরকে তাদের দায় মেটাতে হবে’। তার এমন আগ্রাসী বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, তারা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার মতো শান্তিও চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। যুদ্ধ না হয় চাপিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু, শান্তি কি সত্যিই চাপিয়ে দেওয়া যায়?
গত ৩০ সেপ্টেম্বর আল জাজিরার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—’ট্রাম্পের পরিকল্পনা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য কী অর্থ বহন করে?’ এতে বলা হয়, বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন যে ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। তবে আবারও ইসরায়েলিদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে।
ট্রাম্প-প্রস্তাব প্রকাশের পরদিন বিবিসির এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়, ‘ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলেও আছে মৌলিক বাধা’। প্রতিবেদন অনুসারে—ট্রাম্প গাজা যুদ্ধ বন্ধে নিজের পরিকল্পনাকে ‘সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং এটি ‘মধ্যপ্রাচ্যে চিরশান্তি’ বয়ে আনতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন।

এতে আরও বলা হয়, গাজা যুদ্ধ বন্ধ হলে আখেরে নেতানিয়াহু ও হামাসের শীর্ষ নেতারা কতটুকু লাভবান হবেন এর ওপরেই নির্ভর করছে এই প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ।
গত বুধবার লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক ডেভিড হার্স্ট এমন প্রস্তাবকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে খাটো করা হয়েছে। এটি রাফায় ইসরায়েলি সেনাদের সবসময়ের জন্য রেখে দেওয়ার প্রচেষ্টা বলেও মনে করেন তিনি।
যারা প্রস্তাবটি পড়েছেন তারা জানেন যে, এখানে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যাকে আমলে নেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য এই প্রায় ৮০ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তা তুচ্ছ করা হয়েছে। ট্রাম্প যেন গাজার জমিতে ধনকুবেরদের প্রাসাদ বানানোকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তাই তার প্রস্তাবে গাজার অর্থনৈতিক উন্নয়নই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অর্থাৎ, তিনি যেন মূল সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে ‘চিরশান্তি’র নামে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র দিকে হাঁটতে চাচ্ছেন।
এক নজরে ট্রাম্পের ২০-দফা প্রস্তাব (সংক্ষেপিত):
১. গাজাকে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসমুক্ত অঞ্চল করা হবে যাতে এটি কোনো প্রতিবেশীর জন্য হুমকি না হয়ে উঠে।
২. চরম দুর্দশায় থাকা গাজাবাসীর কল্যাণে গাজার উন্নয়ন করা হবে।

৩. যদি সব পক্ষ এই প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে এখনই যুদ্ধ থামানো হবে। জিম্মি মুক্তির বিষয়ে সবার সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলি সেনাদের গাজা থেকে প্রত্যাহার করা হবে। এই সময়ের মধ্যে আকাশ ও স্থলপথের সব সামরিক অভিযান স্থগিত করা হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ থাকবে।
৪. ইসরায়েল এই চুক্তি মেনে নেওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গাজা থেকে জীবিত ও মৃত সব জিম্মিকে ফেরত দিতে হবে।
৫. সব জিম্মি মুক্তি পাওয়ার পর ইসরায়েলে যাবজ্জীবন কারাবাসী ২৫০ জন ও ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর আটক ১ হাজার ৭০০ গাজাবাসীকে মুক্তি দেওয়া হবে। ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়াদের মধ্যে থাকবে নারী ও শিশু। প্রতি একজন মৃত ইসরায়েলি জিম্মির দেহাবশেষের বিনিময়ে ১৫ মৃত গাজাবাসীর দেহাবশেষ ফেরত দেওয়া হবে।
৬. সব জিম্মি ফেরত আসার পর যেসব হামাস সদস্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে ও অস্ত্র সমর্পণ করবে তাদের ক্ষমা করে দেওয়া যাবে। হামাসের যেসব সদস্য গাজা ছাড়তে চান তাদের নিরাপদে যে দেশে যেতে চান সে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
৭. চুক্তি মেনে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গাজা উপত্যকায় পুরোপুরিভাবে ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হবে। ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি মানবিক সহায়তাবিষয়ক চুক্তি অনুসারে ত্রাণ পাঠানো হবে। অবকাঠামো (পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন) ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। হাসপাতাল ও বেকারি গড়ে তোলা হবে এবং ধ্বংসাবশেষ সরাতে ও রাস্তা খুলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাঠানো হবে।
৮. জাতিসংঘ ও এর সংস্থাগুলো, রেড ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেগুলো কোনো পক্ষের সঙ্গে জড়িত নয় সেগুলোর মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারির চুক্তি মোতাবেক রাফাহ সীমান্ত দিয়ে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করা হবে।

৯. অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গাজা পরিচালনা করবে। অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটি গাজার প্রতিদিনকার পরিষেবা ও পৌরসভাগুলো পরিচালনা করবে। যোগ্য ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হবে। ‘বোর্ড অব পিস’ নামের অন্তর্বর্তী নতুন আন্তর্জাতিক কমিটি এগুলো দেখভাল করবে। এই কমিটির প্রধান হবেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প। অন্যান্য সদস্যদের নাম পরে ঘোষণা করা হবে।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এই কমিটিতে থাকবেন। এই কমিটি গাজা পুনর্গঠনের তহবিল পরিচালনা করবে। যতদিন না পর্যন্ত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সংস্কার শেষ হয় এবং গাজার নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে নিতে না পারে ততদিন পর্যন্ত এই কমিটি কাজ করে যাবে। এই কমিটি গাজাবাসীকে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিকমানের সেবার জন্য আধুনিক ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা ও গাজায় বিনিয়োগের আহ্বান জানাবে।
১০. গাজার পুনর্গঠন নিয়ে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্যানেল তৈরি করা হবে। যারা মধ্যপ্রাচ্যে আধুনিক ক্রমবর্ধমান শহর গড়েছেন তাদেরকে এই প্যানেলে রাখা হবে। ভবিষ্যতে গাজায় কর্মসংস্থান তৈরির জন্য বিনিয়োগ টানতে যথাযথ বিনিয়োগ প্রস্তাব ও চমৎকার উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে এমন সুপরিচিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ কাজে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
১১. অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে।
১২. কাউকে গাজা থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হবে না। তবে যারা স্বেচ্ছায় চলে যেতে চান তারা তা পারবেন। আবার কেউ চাইলে ফিরেও আসতে পারবেন। সবাইকে থাকার জন্য উৎসাহ দেওয়া হবে। গাজার উন্নয়নে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
১৩. গাজার শাসনে হামাস ও অন্যান্য সংগঠনকে কোনোভাবেই অংশ নিতে দেওয়া হবে না। সব টানেল ও অস্ত্র কারখানা ধ্বংস করে দেওয়া হবে। স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানের গাজার নিরস্ত্রীকরণের কাজ করা হবে। নতুন গাজার লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
১৪. হামাস ও অন্যান্য দলগুলো যেন তাদের নীতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকে তা নিশ্চিতে আঞ্চলিক অংশীদাররা গ্যারান্টি দেবে। নতুন গাজা যেন এর প্রতিবেশীদের অথবা নিজেদের জনগণের জন্য হুমকি হয়ে না ওঠে সেই নিশ্চয়তাও তারা দেবেন।
১৫. গাজায় মোতায়েন করার জন্য অস্থায়ী ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স (আইএসএফ) গঠনে যুক্তরাষ্ট্র এর আরব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করবে। গাজায় ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনী গড়তে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেবে। জর্ডান ও মিশরের সঙ্গে আলোচনা করবে। সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বাহিনী ইসরায়েলে ও মিশরের সঙ্গে কাজ করবে।

১৬. ইসরায়েল গাজা দখল বা একীভূত করবে না। আইএসএফ স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করলে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) চুক্তি মোতাবেক প্রত্যাহার করা হবে।
১৭. হামাস এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান বা বাস্তবায়নে গড়িমসি করলে আইডিএফ সন্ত্রাসমুক্ত এলাকাগুলো আইএসএফের হাতে তুলে দেবে।
১৮. সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থাননীতির ওপর ভিত্তি করে আন্তঃধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা করা হবে।
১৯. যতদিন গাজা পুনর্গঠন ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সংস্কারের কর্মসূচি চলবে ততদিন ফিলিস্তিনের স্বশাসন ও নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের পথে শর্তগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলবে।

২০. পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানের জন্য ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
এখন দেখার বিষয়—ফিলিস্তিনের জনগণ তথা গাজাবাসীর ওপর ট্রাম্পের এই চাপিয়ে দেওয়া প্রস্তাব বাস্তবে কতটা শান্তি আনতে পারে। শান্তির আড়ালে এটি চিরদিনের জন্য গাজা দখলের নীলনকশা হয়ে উঠে কিনা তাও ভেবে দেখার বিষয়।
নেতানিয়াহু বারবার বলছেন, তিনি কোনোভাবেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে দেবেন না। যদি তাই হয় তাহলে ট্রাম্পের ‘মধ্যপ্রাচ্যে চিরশান্তি’র এই প্রস্তাব কি ভিন্ন কিছু বহন করছে?
ডেইলি স্টারের এক্সপ্লেনার