যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক আচরণ অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে—বিশেষত তার অনলাইন কর্মকাণ্ড। একদিকে দেশ সম্ভাব্য সরকার বন্ধের মুখে, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট এমন কিছু পোস্ট করছেন যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি ঘটে গত সপ্তাহে। ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া ট্রুথ সোশ্যাল-এ একটি এআই-নির্মিত ভিডিও শেয়ার করেন, যেখানে ডেমোক্র্যাট নেতা হাকিম জেফরিস যিনি মার্কিন ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হাউস মাইনরিটি লিডারকে মেক্সিকান পোশাকে দেখানো হয়েছে। ভিডিওতে বাজছে মারিয়াচি সংগীত, আর জেফরিসের মুখে কার্টুনের মতো অতিরঞ্জিত গোঁফ। হিস্পানিক সংগঠনগুলো এই পোস্টকে “বর্ণবাদী”, “বিপজ্জনক” ও “অগ্রহণযোগ্য” বলে তীব্র সমালোচনা করে। কিন্তু ট্রাম্প তাতে বিচলিত না হয়ে আরেকটি ভিডিও পোস্ট করেন—এবার নিজেকে সেই একই পোশাকে দেখিয়ে, গিটার হাতে।
এআই ভিডিও ও বিভ্রান্তির জাল
এখানেই শেষ নয়। কয়েক দিন পর ট্রাম্প আবার একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-নির্মিত ভিডিও শেয়ার করেন, যেখানে দেখা যায় তার নিজের এআই সংস্করণ বসে আছেন ওভাল অফিসে এবং বলছেন—“খুব শিগগিরই প্রত্যেক আমেরিকান তাদের নিজস্ব ‘মেড বেড কার্ড’ পাবেন। এই কার্ডের মাধ্যমে সবাই আমাদের নতুন মেড বেড হাসপাতালগুলোতে যেতে পারবে, যা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি।”
এই বক্তব্য শুনে অনেকেই হতবাক। কারণ “মেড বেড” বা “ম্যাজিকাল হাসপাতাল বেড” আসলে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব—যেখানে দাবি করা হয়, ধনী ও ক্ষমতাশালীরা এমন এক গোপন প্রযুক্তির মালিক, যা সব রোগ সারাতে পারে, কিন্তু তারা তা জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখছে।
প্রশ্ন উঠছে—৭৯ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট কি সত্যিই বিশ্বাস করেন এই ভিডিওতে তিনি নিজেই কথা বলেছেন? তিনি কি মনে করেন হোয়াইট হাউসে বসে এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন?
পরে পোস্টটি মুছে ফেলা হলেও, বিষয়টি অদ্ভুতভাবে অমীমাংসিত থেকে যায়। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট বলেন, “প্রেসিডেন্ট ভিডিওটি দেখেছিলেন এবং শেয়ার করেছিলেন, পরে নিজেই তা সরিয়ে ফেলেছেন। এটা তার নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, তিনি যা খুশি শেয়ার করতে পারেন।”
মানসিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি ট্রাম্পের সাম্প্রতিক আচরণের অংশ মাত্র। কয়েক মাস ধরে তার মানসিক স্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, যেমনটা আগে জো বাইডেনকে ঘিরেও উঠেছিল।
সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে এক বক্তব্যে ট্রাম্প দাবি করেন—গর্ভাবস্থায় মহিলারা যদি টাইলেনল খান, তাহলে শিশুর অটিজম হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একই বক্তৃতায় তিনি বলেন, “শিশুরা কিছু ‘বুদ্ধিমত্তার উপাদান’ নিয়ে জন্মায়”—যা বোঝাতে গিয়ে তার বক্তব্য একেবারে জটলা পাকিয়ে যায়।
এরও আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ভুলবশত আলবেনিয়ার জায়গায় আর্মেনিয়ার নাম বলেন, যখন তিনি আর্মেনিয়া-আজারবাইজান শান্তি চুক্তি নিয়ে কথা বলছিলেন। ফক্স নিউজের এক সাক্ষাৎকারেও তিনি একই ভুল করেন।
ট্র্যাজেডির মধ্যেও বিলাসিতার পোস্ট
রবিবার তিনি ট্রুথ সোশ্যাল-এ লিখেন যে মিশিগানে একটি মরমন গির্জায় গোলাগুলির ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন, এবং তিনি “পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন”। কিন্তু তিন ঘণ্টা পর তার পরবর্তী পোস্টে দেখা গেল সোনার তৈরি আসবাবের ভিডিও, যেখানে তিনি লিখেছেন, “হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিস ও ক্যাবিনেট রুমে ব্যবহৃত ২৪ ক্যারেট সোনার সৌন্দর্য দেখে সবাই মুগ্ধ হয়!”
সেই দিন আর তিনি মিশিগানের ঘটনাটি নিয়ে কিছু বলেননি, বরং নতুন NFL নিয়ম নিয়ে অভিযোগ করেন।
সামরিক বৈঠকে অদ্ভুত মন্তব্য
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, “আমেরিকা এখন আবার সম্মানিত দেশ। বাইডেনের সময় সবাই তাকে প্রতিদিন সিঁড়ি থেকে পড়তে দেখত। আমি সাবধানে হাঁটি, কেউ যেন পড়ে না যায়।” তিনি যোগ করেন, “ওবামার ব্যাপারটা আলাদা, সে তো নাচের মতো করে সিঁড়ি দিয়ে নামত!”
সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ ছিল যখন তিনি বলেন, “আমরা কিছু বিপজ্জনক শহর—যেমন সান ফ্রান্সিসকো, নিউইয়র্ক বা শিকাগো—কে আমাদের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।”
প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক উদ্বেগ
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ব্যারি ম্যাকক্যাফ্রি বলেন, “আমি জীবনে এত অদ্ভুত ও উদ্বেগজনক ভাষণ কখনও শুনিনি। প্রেসিডেন্ট ক্লান্ত, অসংলগ্ন ও বিভ্রান্ত শোনাচ্ছিলেন।”
এই বক্তব্যের পর ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান ম্যাডেলিন ডিন রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসনের মুখোমুখি হয়ে বলেন, “প্রেসিডেন্ট মানসিকভাবে অস্থির, তিনি অসুস্থ।”
জনসন শান্তভাবে জবাব দেন, “আপনাদের দলের অনেকেরও তো একই অবস্থা।”
ট্রাম্পের এইসব পোস্ট ও বক্তব্য এখন কেবল রাজনীতিবিদদের নয়, মনোবিজ্ঞানীদেরও ভাবাচ্ছে। কেউ বলছেন, এটি একজন ক্লান্ত নেতার বিভ্রান্তি, আবার কেউ মনে করছেন, ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবেই বিতর্ক সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফোকাস ধরে রাখতে চাইছেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—যদি দেশের প্রেসিডেন্ট নিজের এআই-ভিডিওকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করেন, তবে হোয়াইট হাউসের সিদ্ধান্তগুলো কতটা বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে?