দুই বছরের রক্তক্ষয়, ধ্বংস আর অবরোধের পর অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতির খবর ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় মানুষের উল্লাস, শিশুরা পতাকা হাতে দৌড়াচ্ছে, বৃদ্ধেরা চোখের পানি মুছে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও একটিই সত্য সবচেয়ে উজ্জ্বল—গাজা বেঁচে আছে কারও দয়ায় নয়, নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে।
২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর। গাজার আল-শিফা হাসপাতালে কিছু শিশু ইংরেজিতে কথা বলেছিল ক্যামেরার সামনে। তারা তাদের মাতৃভাষা নয়, সেই ভাষায় বলছিল যেটি তারা ভাবত হয়তো পশ্চিমা বিশ্ব বুঝবে। এক কিশোর বলেছিল, “আমরা বাঁচতে চাই, আমরা শান্তি চাই, যারা শিশু হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। আমরা খাবার, ওষুধ আর শিক্ষা চাই।” তখনই তারা পানির এক ফোঁটা, খাবারের এক টুকরো কিংবা ওষুধের সামান্য অংশ থেকেও বঞ্চিত ছিল। তারা ভিক্ষা করেছিল মানবিকতার নামে, সেই উপনিবেশকারীর ভাষায়, কারণ তারা ভেবেছিল এতে হয়তো মানুষ তাদের কষ্ট বুঝবে।
আজ প্রায় দুই বছর পর, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি “তার শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ” নিয়ে “অত্যন্ত গর্বিত”। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তার উদ্যোগের প্রশংসা করছেন, আর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদ নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রস্তাব তুলেছেন ট্রাম্পের নামে। সেই নেতারাই আজ ‘শান্তির কৃতিত্ব’ নিচ্ছেন—যারা দুই বছর ধরে, বরং ৭৭ বছর ধরে, এই গণহত্যার জন্য অর্থ, অস্ত্র আর রাজনৈতিক আশ্রয় জুগিয়েছেন।
কিন্তু সত্য হলো—গাজার মানুষকে কেউ বাঁচায়নি। গাজা বেঁচে ছিল শুধু এই পৃথিবী যেন আর তাদের হত্যা না করে, এই ন্যূনতম দাবি নিয়ে। তারা চেয়েছিল কেবল বাঁচার অধিকার—দখল, বর্ণবাদ আর হত্যাযজ্ঞের মুক্তি। তাদের দরকার ছিল না করুণা, দরকার ছিল ন্যায়বিচার।
এই গণহত্যা পুরো বিশ্বকে নগ্ন করে দিয়েছে—যে বিশ্ব ন্যায়বিচারের বুলি আওড়ায়, কিন্তু একইসঙ্গে দমনকারীদের অস্ত্র জোগায়।
তবু গাজা মাথা নত করেনি। তারা নিজেদের গল্প নিজেরাই লিখেছে। তারা প্রমাণ করেছে—অস্ত্র না থাকলেও মানুষ প্রতিরোধ করতে পারে। গাজার প্রতিটি নারী, শিশু আর বৃদ্ধ বেঁচে থাকার মধ্যেই এক নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে ‘অবিচলতা’র।
আমরা ব্যর্থ হয়েছি, গাজা নয়।
গাজা টিকে ছিল যখন পুরো পৃথিবী তাকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল। গাজা লড়েছে, যখন তাকে একা করে দেওয়া হয়েছিল।
আর যারা আজ “শান্তির বার্তা” নিয়ে ক্যামেরার সামনে হাজির হচ্ছেন, তারা-ই সেই লোক, যারা গণহত্যাকে সম্ভব করেছে—যারা বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাঠিয়েছে, জাতিসংঘে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে, আর “অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব” ভেটো করেছে বারবার।
আমেরিকা যুদ্ধ চলাকালেই আরও ১৪.৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে—কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার, ১৫৫ মিমি আর্টিলারি শেল, নাইট ভিশন গিয়ার আর বাংকার ভেদকারী বোমা পাঠিয়েছে। সেই বোমাগুলো ঘুমন্ত পরিবারের ওপরেই পড়েছে।
আমরা যারা পশ্চিমে বসে ‘মানবতা’র বুলি দিই, আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। আমরা নিজেদের ইতিহাসে সঠিক পাশে থাকার গর্ব করি, বলি—‘যদি হলোকাস্টের সময় বাঁচতাম, চুপ থাকতাম না’। অথচ আজ, যখন আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে গণহত্যা চলছে, তখন আমরা নীরব। আমরা শিশুখাদ্য পাঠাতে পারিনি, বরং অনেকেই হত্যার দায় চাপিয়েছে নিহতদের ওপরই।
তবু গাজা টিকে আছে। কারণ তারা নিজেরাই সত্যের সাক্ষী হয়ে উঠেছে। তারা নিজেদের মৃত্যুও লাইভস্ট্রিম করেছে, যাতে কেউ বলতে না পারে—“আমরা জানতাম না।”
এই যুদ্ধবিরতি এসেছে তাদের রক্তের বিনিময়ে। কারণ বোমা ভাঙতে পারেনি তাদের আত্মা। কারণ বিশ্বব্যাপী মানুষ ইসরায়েলের মিথ্যা আর “আত্মরক্ষার গল্প” বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছে।
মাহমুদ দারবিশ অনেক আগেই এই পরিণতি বুঝেছিলেন—
“যুদ্ধ শেষ হবে। নেতারা হাত মেলাবে।
বৃদ্ধা মা অপেক্ষা করবে তার শহিদ ছেলের জন্য।
মেয়েটি অপেক্ষা করবে তার প্রিয় স্বামীর জন্য।
শিশুরা অপেক্ষা করবে তাদের বীর বাবার জন্য।
আমি জানি না কে আমাদের ভূমি বিক্রি করল,
কিন্তু আমি জানি কে এর দাম দিল।”
আজ সেই দামই পরিশোধ করেছে গাজার মানুষ।
এখন ‘শান্তি’ শব্দটি শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সত্যিকারের শান্তি আসবে তখনই যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। শুধু ইসরায়েল নয়, যারা এই হত্যাযজ্ঞে অর্থ, অস্ত্র বা নীরবতা দিয়ে অংশ নিয়েছে—তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
ইসরায়েলের ওপর পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, দখলকৃত ভূমি থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি এবং ক্ষতিপূরণ—সবকিছু ফিলিস্তিনিদেরই নিয়ন্ত্রণে দিতে হবে। বিচার হতে হবে হেগে, যত বড় দেশই আপত্তি জানাক না কেন।
ট্রাম্পের কথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’ আসলে প্রতিটি নিহত শিশুর সঙ্গে মরেছে।
যে রাষ্ট্র দখলদার, সে কখনো আত্মরক্ষার দাবি করতে পারে না—এই আন্তর্জাতিক আদালতের রায় আমরা ভুলে যাইনি।
একটি ন্যায্য ভবিষ্যৎ মানে একটিই জিনিস—সম্পূর্ণ মুক্তি।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে—নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত।
তবে তার আগে গাজার মানুষকে তাদের মৃতদের কবর দিতে দাও, কান্না করতে দাও, আনন্দ করতে দাও। তারা এই ক্ষণিকের সুখের অধিকার অর্জন করেছে।
আর আমাদের—বিশ্বের বাকিদের—কর্তব্য এই যে আমরা যেন আবার আগের মতো নির্লিপ্ত হয়ে না যাই। যেন এই যুদ্ধবিরতি আমাদের ঘুম পাড়িয়ে না দেয়। দখল আর বর্ণবাদের যন্ত্রণা চলতে থাকলে, কোনও যুদ্ধবিরতিই শান্তি নয়।
গাজার রক্ত আজ আমাদের বিবেকের ওপর প্রশ্ন রেখে গেছে।
আর সেই প্রশ্নের উত্তর একটাই—
“স্বাধীন ফিলিস্তিন, নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত।”

