শ্যাডো ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টিগেশনস-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন মতে, অস্ত্র কোম্পানিগুলোতে অর্থ ঢালা কেবল নৈতিকতার অবক্ষয়ই নয়, বরং এটি নরওয়েকে গাজায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে জড়িত করছে। ইসরায়েলি অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের কারণে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে রয়েছে নরওয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের আরটিএক্স এবং জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো কোম্পানিগুলোয় নরওয়ের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও সামরিক যানের ইঞ্জিন এবং ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়।
বিশ্বজুড়ে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্মস্থান হিসেবে নরওয়ের যে সুনাম রয়েছে, গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তা পড়েছে কঠিন প্রশ্নের মুখে। দেশটির বিশাল সার্বভৌম সম্পদ তহবিল পরিচিত ‘নৈতিক বিনিয়োগের মডেল’ হিসেবে। সেই তহবিলই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। বিশ্বব্যাপী অস্ত্র বিক্রি, সামরিক চুক্তি ও দুর্নীতির নেটওয়ার্ক নিয়ে অনুসন্ধানকারী সংস্থা শ্যাডো ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টিগেশনস-এর নতুন গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
সুইডিশ উদ্ভাবক আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছানুসারে, ১৯০১ সাল থেকে নরওয়ের অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এই পুরস্কার মূলতঃ নিরস্ত্রীকরণ, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও সংঘাত নিরসনের কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্মানিত করে। কিন্তু এই ঐতিহ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অর্থনৈতিক বৈপরীত্য।
নরওয়ের সরকারি মালিকানাধীন তহবিল মূলতঃ গভর্নমেন্ট পেনশন ফান্ড গ্লোবাল (জিপিএফজি) বা নরওয়েজিয়ান অয়েল ফান্ড নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের বৃহত্তম সার্বভৌম সম্পদ তহবিল। তেল ও গ্যাস রফতানির মুনাফা থেকে তৈরি হওয়া এই তহবিলের মূল্য ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
শ্যাডো ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টিগেশনস ফর মিডল ইস্ট আইয়ের নতুন গবেষণা অনুযায়ী, এই তহবিল বিশ্বের শীর্ষ ১০০ অস্ত্র কোম্পানির মধ্যে ৪৯টির শেয়ারের মালিক, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। এই কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসরায়েলকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে।
নরওয়ের এই তহবিলের নিজস্ব নৈতিক নির্দেশিকায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন বা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসরায়েলের বৃহত্তম অস্ত্র কোম্পানি এলবিট সিস্টেমস-কে ২০০৯ সাল থেকে এই তহবিল থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু বর্তমানে গাজা যুদ্ধে জড়িত কোম্পানিগুলোতে বিপুল বিনিয়োগ থাকায় এর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলবিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ নরওয়ের অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছেন যে, ইসরায়েলি অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের কারণে নরওয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
নরওয়ের নাগরিক সমাজ এবং ফিলিস্তিনি অধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপগুলোও এই বিনিয়োগ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। তাদের মতে, অস্ত্র কোম্পানিগুলোতে অর্থ ঢালা কেবল নৈতিকতার অবক্ষয়ই নয়, বরং এটি নরওয়েকে গাজায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে জড়িত করছে।
মূলতঃ দুটি প্রধান কারণে এই বিপুল বিনিয়োগ করে নরওয়ে সরকার, লাভজনক ও কৌশলগত কারণ। স্থিতিশীল চাহিদা, প্রত্যাশিত মুনাফা এবং সরকারি সমর্থনের কারণে অস্ত্র কোম্পানিগুলো তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতি এই কোম্পানিগুলোর মুনাফা আরো বাড়িয়ে তোলে।
তাছাড়া, এই বিনিয়োগগুলো নরওয়ের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতেও সাহায্য করে।
ন্যাটোর সদস্য হিসেবে এবং রাশিয়ার কাছাকাছি অবস্থান করায় ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নরওয়ের নিজস্ব প্রতিরক্ষা চাহিদা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দেশটিতে অস্ত্র শিল্পের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই অর্থনৈতিক লাভ এবং কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টাই নরওয়ের ‘নৈতিক বিনিয়োগের’ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে।
গাজা পরিস্থিতির অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে নরওয়ে সরকার ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জোরদার করেছে এবং ২০২৪ সালের মে মাসে স্পেন ও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত কিছু কোম্পানি থেকে নরওয়ে তার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে, নরওয়ে তহবিল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ভূমি দখল এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মার্কিন নির্মাণ জায়ান্ট ক্যাটারপিলার এবং পাঁচটি ইসরায়েলি ব্যাংকসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। মে মাসে তারা ইসরায়েলের বৃহত্তম জ্বালানি সরবরাহকারী পাজ রিটেল অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেডকেও বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে ইসরায়েলি কোম্পানির সংখ্যা ৬১ থেকে কমে ৩৮-এ নেমে আসে।
কিন্তু সমালোচকদের মতে, অস্ত্র সরবরাহকারী মূল কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত নরওয়ের ‘নৈতিকতার মুখোশ’ টিকে থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরটিএক্স এবং জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো কোম্পানিগুলোয় নরওয়ের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও সামরিক যানের ইঞ্জিন এবং ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়।
এই বিনিয়োগগুলো প্রমাণ করে যে, নোবেল শান্তি পুরস্কারের দেশ হওয়া সত্ত্বেও নরওয়ে তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থকে নৈতিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিচ্ছে।

