ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তীব্র ন্যায়বিচারের ছায়া পড়েছে। মাত্র এক মাসে ২,৫০০-এর বেশি মানুষকে অভিযোগের মুখে ফেলা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড এবং জম্মু-কাশ্মীরের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে পুলিশ মুসলিমদের ঘরবাড়ি এবং মার্কেটেও হানা দিয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে।
এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু কি? সেটা খুব সাধারণ: “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা পোস্টার, টি-শার্ট বা সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট। এই লেখাকে ভারতের স্থানীয় প্রশাসন “সার্বজনীন শৃঙ্খলার জন্য হুমকি” হিসেবে দেখছে।
ঘটনাপ্রবাহ কোথা থেকে শুরু হলো?
সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখে উত্তরপ্রদেশের কানপুর শহরে মুসলিমরা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করছিলেন। এই সময় একটি এলাকায় একটি আলোয় সজ্জিত বোর্ড বসানো হয়, যাতে লেখা ছিল “আই লাভ মুহাম্মদ”। বোর্ডটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় “আই লাভ নিউ ইয়র্ক” বোর্ডের মতো ডিজাইন করা। কিন্তু কিছু হিন্দু বাসিন্দা তা আপত্তিজনক মনে করে। প্রথম অভিযোগ ছিল, নতুন কোনো উপকরণ যোগ করা মানচিত্রিত ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উৎসবের নিয়মভঙ্গ। কানপুরে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ।

কিন্তু অভিযোগ ভিত্তিতে পুলিশ ২৪ জনকে আরও গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করে: ধর্মীয় শত্রুতার প্ররোচনা। এই অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা কড়া সমালোচনা শুরু করেন। প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে অন্য রাজ্যেও। কেবল কানপুর নয়, অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া বা টি-শার্টে “আই লাভ মুহাম্মদ” লিখে নিজেদের সমর্থন দেখাচ্ছেন।
উত্তরপ্রদেশের বারেলি শহরে, কানপুরের ঘটনার প্রতিবাদে একটি স্থানীয় ইমামের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে পুলিশ এবং নাগরিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে ইমাম তাওকীর রাজা, তার আত্মীয় ও সহযোগীরা অন্তর্ভুক্ত। অভিযুক্তদের অন্তত চারটি ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পূর্বেও স্পষ্ট করেছেন যে, বাড়ি ধ্বংসকে কোনো ধরনের অ-আইনগত শাস্তি হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। তবে বাস্তবে, অনেক সময় সরকারি কর্তৃপক্ষ এটি উপেক্ষা করে।
আইনি অবস্থান কেমন?
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করেছে। ধারা ২৫ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের নিজের ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা রয়েছে। ধারা ১৯(১)(ক) নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয়, তবে এটি শুধুমাত্র তখনই সীমিত হতে পারে যখন সরাসরি সহিংসতা বা বিদ্বেষ উস্কানি দেওয়া হয়।

“আই লাভ মুহাম্মদ” নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পুলিশ মূলত বড় জমায়েত বা ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি সম্পর্কিত আইনি ধারা প্রয়োগ করছে। কিন্তু অনেক সময় একই ধারা সামাজিক মিডিয়া পোস্ট বা টি-শার্টের কারণে ব্যবহার করা হয়েছে।
এপিসিআর-এর নাদিম খান জানান, সরকার জানে “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা একমাত্র কারণে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। বরং তারা দেখাচ্ছে, যারা এই লেখা ব্যবহার করেছে বা পুলিশি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করেছে, তাদের কর্মকাণ্ডে অভিযোগ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইন্ডিয়ার চেয়ার আকার প্যাটেল বলেন, “শান্তিপূর্ণ এবং কোনো হুমকি বয়ে আনা নয় এমন ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ ধরনের স্লোগানের জন্য মানুষকে টার্গেট করা আন্তর্জাতিক ও সংবিধানগত মানবাধিকার আইন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়।”
বিভাজনের ধারা কি দেখা যাচ্ছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনাটি শুধু সাম্প্রতিক নয়। ২০১৪ সালের পর থেকে, মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে, ভারতীয় মুসলিমরা অনেক সময় সংখ্যালঘু হিসেবে লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। হিংসা, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং সামাজিক বিচ্যুতি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১১ বছরে হিংসাত্মক ভাষার ঘটনা ৬৬৮ থেকে ১,১৬৫-এ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে বেশিরভাগ ঘটনা বিজেপি শাসিত রাজ্যে।

এই বিতর্কে যুব মুসলিমদের উদ্বেগও বাড়ছে। তরুণরা দেখছে যে, সকলের জন্য একই নিয়ম প্রয়োগ হয় না। এপিসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, অনেক গ্রেপ্তার ব্যক্তি যুব মুসলিম। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের চাপ তরুণদের আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রশিদ কিদওয়াই বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বিতর্ক খুবই রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়।” অন্যরা বলছেন, “ধর্মীয় পরিচয়ের প্রকাশকে ক্রমবর্ধমানভাবে হিংসার সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হচ্ছে, যা বিপজ্জনক সামাজিক বিভাজনের পথ খুলে দেয়।”
ভারতে মুসলিম তরুণদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। যারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্মীয় ভাব প্রকাশ করছে, তাদের উপর আইন প্রয়োগের প্রভাব শুধু সামাজিক শোষণই নয়, একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংকেতও হয়ে দাঁড়াচ্ছে।