ইরানের সাবেক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর শাসনামলে কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের জন্য বিখ্যাত ছিল।
এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী নেতাদের দমন করা এবং তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো। সাভাক-এর ভয়ঙ্কর ইতিহাস আজও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গবেষকদের মধ্যে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত।
এর প্রধান কর্মকর্তা পারভেজ সাবেতি (৮৯) ১৯৭৮ সালে তেহরান থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসে ৪৫ বছরের জন্য নিজেকে গোপনে রেখেছিলেন। ফ্লোরিডার উইন্ডারমের একটি বিলাসবহুল আবাসিক এলাকায় তিনি পিটার ছদ্মনামে বাস করতেন। দীর্ঘদিন ধরে আপাতদৃষ্টিতে শান্তশিষ্ট এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ হিসেবেই মানুষ তাঁকে চিনত। কিন্তু সম্প্রতি সাবেতির অতীতের পরিচয় ফাঁস হয়েছে এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
সাবেক তিন রাজনৈতিক বন্দী সম্প্রতি সাবেতির বিরুদ্ধে ২২৫ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ২,৪০০ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করেছেন। বাদী তিন জনের বয়স বর্তমানে ৬৮ থেকে ৮৫ বছরের মধ্যে এবং তারা বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করেন। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, সাবেতির সরাসরি নির্দেশে তেহরানের কারাগারে তাঁদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার চালানো হয়েছিল। এই অত্যাচারের মধ্যে ছিল ধর্ষণ, বৈদ্যুতিক শক, পানিতে ডুবিয়ে রাখা এবং হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা।

সাভাকের নৃশংস যন্ত্র এবং নির্যাতনের কৌশল-
বাদীপক্ষের অভিযোগ অনুসারে, সাভাকের কারাগারে ‘অ্যাপোলো’ নামে একটি বৈদ্যুতিক চেয়ার ব্যবহার করা হতো। এই যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ধাতব হেলমেট পরার কারণে নির্যাতিত ব্যক্তির যন্ত্রণার চিৎকার বহুগুণে বৃদ্ধি পেত এবং নিজের কানে ফিরে আসত। ফলে চিৎকার করলে যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেত। এই নৃশংস কৌশল ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইতিহাসে একটি কালো দাগ হিসেবে রয়ে গেছে।
পারভেজ সাবেতি শাহের শাসনামলে সাভাকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তাঁকে শাহের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং ভয়ংকর পুরুষদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মার্কিন সিআইএর ১৯৭৮ সালের একটি গোপন নথিতেও সাবেতিকে শাহের একান্ত অনুগত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সময়ে তাঁর হাতে ছিল দেশের বিরোধীদের গ্রেপ্তার, জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিচারের ক্ষমতা। সাভাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭৯ সালে বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে আটক ও নির্যাতন করা হয়েছে।
আদালতের রায় ও আইনি প্রক্রিয়া-
সাবেতির আইনজীবীরা মামলা খারিজ করার আবেদন করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, অভিযোগ দায়েরের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। তবে ফ্লোরিডার কেন্দ্রীয় ফেডারেল জেলা আদালতের বিচারক গ্রেগরি প্রেসনেল ১২ আগস্ট সাবেতির আবেদন আংশিকভাবে খারিজ করেন। বিচারক রায় দেন, নির্যাতনের অভিযোগ সুরক্ষা আইনের অধীনে গ্রহণযোগ্য এবং এটি বিচারাধীন হবে। তবে রাজ্যের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো খারিজ করা হয়েছে।

এখন উভয় পক্ষকে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। যদি প্রমাণিত হয় যে অভিযোগ দায়েরের সময়সীমার মধ্যে করা হয়েছে, তবে আগামী বছরই বিচার শুরু হতে পারে। সাবেতি দাবি করেছিলেন, তিনি সর্বদা নির্যাতনের বিরোধী ছিলেন এবং সাভাক কখনো বন্দীদের নির্যাতন করত না।
আত্মগোপন ও পরিচয় ফাঁস-
সাবেতি ও তাঁর স্ত্রী নাসরিন (৭৫) ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, তারা ইরান থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর তাঁরা নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে পিটার ও ন্যান্সি রাখেন। সাবেতি ফ্লোরিডায় একটি রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং অরেঞ্জ কাউন্টিতে ৩.৫ মিলিয়ন ডলারের ম্যানশনসহ কমপক্ষে আটটি সম্পত্তির মালিক হন।
পরিচয় ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সাবেতির এক মেয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে একটি র্যালিতে বাবার ছবি টুইট করেন। এর মাধ্যমে সাবেতির অবস্থান সনাক্ত করা সম্ভব হয় এবং বাদীপক্ষ মামলা দায়ের করতে সক্ষম হয়।
বর্তমান অবস্থা ও প্রতিক্রিয়া-
বর্তমানে সাবেতি সাবেক শাহের পুত্র রেজা পাহলভীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন বলে জানা গেছে। বাদীপক্ষের আইনজীবী সারা কোলন আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মামলা দায়েরের পরও মক্কেলরা হত্যার হুমকি ও ভয়ভীতি সম্মুখীন হচ্ছেন।
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পক্ষে কাজ করা ‘ইরানি কালেক্টিভ ফর জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ সংস্থাটি জানিয়েছে, সাবেতির এই মামলা শাহের শাসন এবং পরবর্তী ইসলামি সরকারের অধীনে চলা হিংসার চক্র বন্ধ করতে সাহায্য করবে।
সংস্থাটির মুখপাত্র বলেন, “সকল ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য এবং নির্যাতন ও নিপীড়নে জড়িত প্রত্যেককেই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।”
পরিশেষে, ৪৫ বছর ধরে স্বাভাবিক ও শান্তশিষ্ট জীবন যাপনের পর পারভেজ সাবেতি এখন বিচারের মুখোমুখি। ফ্লোরিডার বিলাসবহুল বাড়ি, পিটার ছদ্মনাম এবং দীর্ঘকালীন আত্মগোপন তাকে অদৃশ্য করতে পেরেছিল। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নৃশংস নির্যাতনের দায় এড়াতে পারবে না। এই মামলা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ইরানের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। সাবেতির বিচারের প্রক্রিয়া ভুক্তভোগী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজরে থাকবে।