গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় দুই বছরের মধ্যে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আবার বিশাল মানবিক সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। গাজা উপত্যকার দৃশ্যমান ধ্বংসযজ্ঞ ও দুর্ভিক্ষ বিশ্বের নজর কাড়লেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে যেন এই যুদ্ধবিরতি অকালেই এসেছে।
কিছু পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নেতানিয়াহু যুদ্ধকে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, বিশেষ করে স্বাধীনতার চ্যালেঞ্জগুলো, যেমন বিভিন্ন মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার লড়াই।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও- নেতানিয়াহুর সামনে থাকা সমস্যাগুলো এখনও অমোচনীয়। তিনি চেষ্টা করছেন এই পরিস্থিতিকে নিজের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করতে। তবে সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলন পিনকাসসহ অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই যুদ্ধবিরতি মূলত একটি সাজানো নাটক, যা হোয়াইট হাউসের চাপের মুখে নেতানিয়াহু মেনে নিয়েছেন। গাজার সংঘাতের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বোঝা ওয়াশিংটন আর বইতে রাজি ছিল না।
নেতানিয়াহুর সামনে কয়েকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ দাঁড়িয়ে আছে, চলুন সেগুলো একে একে বিশ্লেষণ করে দেখি—
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একাকিত্ব-
বর্তমানে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তুলনামূলকভাবে নিঃসঙ্গ। বিশেষ করে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েলের অবস্থান আগের তুলনায় একা হয়ে গেছে। গত দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। খাদ্য ও ওষুধের সীমাবদ্ধতা, অবরুদ্ধ অবস্থা ও দুর্ভিক্ষের ছবি বিশ্বমঞ্চে ইসরায়েলের বিরূপ চিত্র উপস্থাপন করেছে।
যদি নেতানিয়াহু স্থায়ীভাবে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে বাধা দেন, তাহলে এই হত্যাযজ্ঞের ছবি আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাবে। এর ফলে ইসরায়েলের একঘরে অবস্থান আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। যুদ্ধবিরতিকে তিনি বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলেও, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এটিকে কৌশলগত নাটক হিসেবেই দেখছেন।
নেতানিয়াহুর ‘সুপার স্পার্টা’ পরিকল্পনা তার কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতার প্রমাণ। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ইসরায়েলকে একটি প্রাচীন স্পার্টার আদলে এমন রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে যা অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, কূটনৈতিকভাবে আলাদা এবং যুদ্ধকেই জীবনধারার অংশ হিসেবে গ্রহণ করবে। তবে এই ঘোষণার পর তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক পতন ও শেকেলের অবমূল্যায়ন ইঙ্গিত দেয় যে, দেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এই পরিকল্পনা স্বাগত জানায়নি। ‘ইসরায়েল বিজনেস ফোরাম’ উল্লেখ করেছে, “আমরা স্পার্টা নই।”
দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব ও জোট সরকার-
নেতানিয়াহুর জন্য দক্ষিণপন্থী জোটসদস্যরা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধবিরতি ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন তিনি চরম দক্ষিণপন্থীদের ওপর নির্ভর করেছেন। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভির—যারা যুদ্ধবিরতির বিরোধী ছিলেন—ও এখনো নেতানিয়াহুর জোটে আছেন।
নেতানিয়াহু আশা করছেন, ইয়েশিভা শিক্ষার্থীদের সামরিক নিয়োগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পরিকল্পনা দ্বারা আলট্রা-অর্থডক্স দলগুলো পুনরায় জোটে ফিরবে। এর ফলে কোনো দল বিচ্ছিন্ন হলেও জোট সরকার টিকে থাকবে। এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা নির্বাচনের আগে জোটের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আইসিজে-
নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলের জন্য আন্তর্জাতিক আইনি চ্যালেঞ্জও ভয়ানক। আইসিসি ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ-এর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। পরবর্তীতে দেইফকে ইসরায়েল হত্যা করে।
অন্যদিকে, আইসিজে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া জাতিসংহার মামলা শুনছে। যদি আদালত ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তবে আন্তর্জাতিক মহলে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক দায়শীলতা নিয়ে সমালোচনা আরও তীব্র হবে। আইসিসির মামলার কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই, আর আইসিজের রায়ও ২০২৭ সালের আগে আসার সম্ভাবনা কম। আইসিসি দোষী সাব্যস্ত করলে সর্বোচ্চ ৩০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে, আর আইসিজের রায় সাধারণত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়।
ট্রাম্পের সমর্থন ও সীমাবদ্ধতা-
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থক। ট্রাম্পের সমর্থন ছাড়া নেতানিয়াহু মারাত্মক কূটনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হবেন। তবে ট্রাম্পের ধৈর্য সীমিত। ২০২১ সালে তিনি নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ছিলেন। নেতানিয়াহু জো বাইডেনকে অভিনন্দন জানানোয় ট্রাম্পের ক্ষোভ দেখা দেয়।
সাম্প্রতিক দোহায় হামাস আলোচনার সময় ইসরায়েলি বিমান হামলা ট্রাম্পকে বিরক্ত করেছে। তিনি মন্তব্য করেছেন, “নেতানিয়াহু আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে।” যুদ্ধবিরতির আগে ট্রাম্প সরাসরি বলেছেন, ইসরায়েল গাজায় পুনরায় ঢুকবে না, যতক্ষণ না তিনি অনুমোদন দেন। তাই নেতানিয়াহু যদি স্থিতাবস্থা নষ্ট করেন, ট্রাম্পের সমর্থন হ্রাস পাবে।
নিরাপত্তা ব্যর্থতা ও ৭ অক্টোবর হামলার তদন্ত-
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলায় ১,১৩৯ জন নিহত হন, এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। তদন্তে দেখা গেছে, ইসরায়েলের সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল। তদন্তের ফলে সেনা ও গোয়েন্দা প্রধান পদত্যাগ করেছেন।
নেতানিয়াহু নিজ সরকারের ভূমিকা নিয়ে হওয়া তদন্তের বিরোধিতা করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হবে। তবে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত ৩০ দিনের মধ্যে সরকারকে জবাব দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
দুর্নীতি মামলা ও জেল সম্ভাবনা-
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতি মামলা চলমান। অভিযোগ রয়েছে ঘুষ, জালিয়াতি ও আস্থাভঙ্গের। যুদ্ধ চলাকালীন কিছু বিলম্ব হলেও মামলার কার্যক্রম থেমে থাকেনি। দোষী প্রমাণিত হলে তাঁকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
গত সোমবার ট্রাম্পও ইঙ্গিত দিয়েছেন, গাজার যুদ্ধ ও নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলার মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে। তিনি পার্লামেন্টে আহ্বান জানিয়েছেন নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করার জন্য, তবে রাজনৈতিক ও আইনি বাস্তবতায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে মামলার চাপ অব্যাহত থাকবে।
পরিশেষে, যুদ্ধবিরতি এবং সাময়িক স্থিতিশীলতার পর নেতানিয়াহুর জন্য রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক একাকিত্ব, দক্ষিণপন্থীদের জোট ভাঙার সম্ভাবনা, আইসিসি ও আইসিজের মামলা, ট্রাম্পের সমর্থনের অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ব্যর্থতা এবং দুর্নীতি মামলাগুলো একত্রে নেতানিয়াহুর রাজনীতিকে ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে ফেলেছে।
নেতানিয়াহুর জন্য প্রধান কাজ হবে নিজের রাজনৈতিক শক্তি ধরে রাখা, জোটের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক আদালতের চাপ মোকাবিলা করা। যদিও গাজার যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তি এনেছে, বাস্তবে নেতানিয়াহুর জন্য সামনে কঠিন সময় শুরু হয়েছে।
এভাবে গাজার যুদ্ধবিরতি তাঁর রাজনৈতিক কৌশল ও নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও- এগুলো ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে–পরে নেতানিয়াহুর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই ছয়টি চ্যালেঞ্জকে তিনি কতটা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় প্রভাব ফেলবে।