একসময় ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রিন্স অ্যান্ড্রু ছিলেন মাতৃকাত্তিক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রিয় ছেলে। সুদর্শন, চৌকস এবং সেনাবাহিনীতে সফল তরুণ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ মানুষ প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে সেই রাজকীয় সদস্য হিসেবে মনে করেন না; বরং মনে করেন তিনি কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে।
প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বয়স এখন ৬৫। তিনি প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছোট ছেলে এবং বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের ভাই। গতকাল শুক্রবার এক ব্যক্তিগত বিবৃতিতে প্রিন্স অ্যান্ড্রু ঘোষণা করেছেন, তিনি ডিউক অব ইয়র্কসহ তাঁর সমস্ত রাজকীয় উপাধি ত্যাগ করছেন।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে ওঠা কুখ্যাত মার্কিন ধনকুবের প্রয়াত জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্ক এবং শিশু যৌন নিপীড়ণের অভিযোগ। কয়েক বছর আগে ভার্জিনিয়া জিউফ্রি নামের এক নারী যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে অভিযোগ করেন, ২০০১ সালে প্রিন্স অ্যান্ড্রু তাঁকে যৌনভাবে নিপীড়ন করেছিলেন। সেই সময় জিউফ্রির বয়স মাত্র ১৭ বছর ছিল। পরে জিউফ্রি মারা যান এবং তাঁর পরিবার দাবি করেন, মানসিক চাপে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
এপস্টেইনের সঙ্গে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বাকিংহাম প্যালেসের ওপর চাপ বাড়ছিল। এই চাপের কারণে হয়তো তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর রাজকীয় উপাধি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া, তিনি যুক্তরাজ্যের প্রাচীনতম ও মর্যাদাপূর্ণ নাইটশিপ অর্ডার অব দ্য গার্টার-এর সদস্যপদও ত্যাগ করছেন।
নিজের সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে প্রিন্স অ্যান্ড্রু বলেন, “রাজা, আমার নিকটাত্মীয় ও বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পর আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, আমার বিরুদ্ধে চলমান অভিযোগগুলো মহামান্য রাজা ও রাজপরিবারের কাজকে বিঘ্নিত করছে।”
তিনি আরো বলেন, “আমি সব সময় পরিবারের এবং দেশের প্রতি আমার দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। পাঁচ বছর আগে জনজীবন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং এখনও সেই সিদ্ধান্তে অটল আছি। মহামান্য রাজার সম্মতিতে আমরা মনে করেছি, এখন আমার আরও এক ধাপ এগোনো উচিত। আমি আর আমার উপাধি বা প্রাপ্ত সম্মানগুলো ব্যবহার করব না। তবে আমি আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করছি।”
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির খবর অনুসারে, প্রিন্স অ্যান্ড্রুর এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজা চার্লস এবং যুবরাজ প্রিন্স উইলিয়ামের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে। যদিও তিনি রাজকীয় উপাধি ত্যাগ করছেন, তবুও তিনি প্রিন্স হিসেবে থাকবেন। তবে ডিউক অব ইয়র্ক উপাধি আর বহন করবেন না। এই উপাধি তিনি মা প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
প্রিন্স অ্যান্ড্রু দীর্ঘদিন ধরেই ব্রিটিশ রাজপরিবারের দায়িত্বশীল সদস্য ছিলেন না। ২০২২ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথই তাঁর সামরিক এবং রাজকীয় মর্যাদা ফেরত নিয়েছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ‘হিজ রয়্যাল হাইনেস’ পদবিও ব্যবহার করতে পারতেন না এবং রাজপরিবারের আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন না। এখন তাঁর ভূমিকা আরও সীমিত হবে।
গত কয়েক বছরে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর নাম একাধিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভার্জিনিয়া জিউফ্রির যৌন নিপীড়নের মামলা, তাঁর আর্থিক বিষয় সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন এবং অভিযুক্ত চীনা গুপ্তচরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ।
প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সাবেক স্ত্রী সারাহ ফার্গুসনও আর ডাচেস অব ইয়র্ক উপাধি বহন করবেন না। তবে তাঁদের দুই মেয়ে প্রিন্সেস উপাধি বহন করতে পারবেন। প্রিন্স অ্যান্ড্রু সম্ভবত উইন্ডসরের রয়্যাল লজ-এ তাঁর বাড়িতে থাকবেন। এই বাড়ির একটি অংশ তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইজারা নিয়েছেন, যার মেয়াদ ২০৭৮ সাল পর্যন্ত।
২০১৯ সালে বিবিসি নিউজনাইট-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রিন্স অ্যান্ড্রু জানান, ২০১০ সালের ডিসেম্বরের পর তিনি এপস্টেইনের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ রাখেননি। তবে কয়েকটি ই-মেইল বার্তা প্রমাণ করে, তারপরও ব্যক্তিগতভাবে তিনি এপস্টেইনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
প্রিন্স অ্যান্ড্রু স্বীকার করেছেন, এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তিনি কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন এবং তাঁর ওপর নজরদারি শুরু হয়েছে। তাঁর সব সিদ্ধান্তে রাজপরিবার এবং যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং জনগণের ভাবমূর্তির প্রতিফলন বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
এভাবে, যৌন কেলেঙ্কারির চাপ এবং এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে প্রিন্স অ্যান্ড্রু স্বেচ্ছায় তাঁর রাজকীয় উপাধি ত্যাগ করেছেন। তিনি নিজের ভূমিকা সীমিত করে রাজপরিবারের সম্মান ও দায়িত্বকে অক্ষত রাখার চেষ্টা করছেন। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রিন্স অ্যান্ড্রু ব্রিটিশ রাজপরিবারের মধ্যে বিতর্ক কমাতে এবং দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি রোধে সচেষ্ট হয়েছেন।