একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন এক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ‘বিরল খনিজ কূটনীতি’ বা রেয়ার আর্থ ডিপ্লোমেসি। অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্প—সব ক্ষেত্রেই এটি বৈশ্বিক শক্তির নতুন মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতার প্রায় প্রতিটি খাতে অপরিহার্য ১৭টি বিরল খনিজ উপাদানকে ঘিরে এখন এশিয়া জুড়ে শক্তির নতুন দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।
ধারণা করা হয়, বিশ্বের অব্যবহৃত বিরল খনিজ মজুদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাটিতে লুকিয়ে আছে, যা ভবিষ্যতের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনীতিতে নতুন অগ্রাধিকার তৈরি করেছে।
রসায়নবিদদের মতে, ল্যান্থানাম থেকে লুটেটিয়াম পর্যন্ত ১৫টি ‘ল্যান্থানাইড’ উপাদান, সঙ্গে স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম—এই ১৭টি উপাদানই বিরল খনিজ নামে পরিচিত। এগুলোর ব্যবহার যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন সেন্সর, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক যানবাহন, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি থেকে শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে এর গুরুত্ব এতটাই গভীর যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলো এগুলোকে ‘কৌশলগত উপাদান’ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেছে। টেসলা, টয়োটা, বিএমডব্লিউসহ প্রায় সব বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা সংস্থা এসব উপাদানের ওপর নির্ভরশীল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার এবং ইভি শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধি আগামী এক দশকে বিরল খনিজের চাহিদাকে বহুগুণ বাড়াবে। ফলে এসব উপাদান এখন কেবল শিল্প কাঁচামাল নয়, বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি ও শক্তির ভূরাজনীতির হাতিয়ার। চীন দীর্ঘদিন ধরে এই খাতের উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে একচ্ছত্র প্রভাব ধরে রেখেছে; তাই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এখন বিকল্প উৎস খুঁজে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নজর দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ও গোল্ডম্যান স্যাকস গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিরল খনিজ মজুদের ২০ শতাংশেরও বেশি রয়েছে এশিয়ায়। চীন নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ব মজুদের ৪৯ শতাংশ এবং খননের ৬৯ শতাংশ, আর প্রসেসিং বা পরিশোধনের ক্ষেত্রে তার অংশীদারিত্ব প্রায় ৯০ শতাংশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখনও বহু অনাবিষ্কৃত খনি ছড়িয়ে রয়েছে—শুধু ভিয়েতনামেই প্রায় ৩৫ লাখ টনের রিজার্ভ, আর মিয়ানমার ২০১৭–২০২৪ সালের মধ্যে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের খনিজ চীনে রপ্তানি করেছে।
এই একচ্ছত্রতা ভাঙতেই যুক্তরাষ্ট্র নতুন কৌশল নিচ্ছে। মিয়ানমার ইস্যুতেও তাদের নীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। দেশটির কাচিন রাজ্যের খনিজসম্পদ বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকায়, ওয়াশিংটন এখন সরকারি বাহিনী বা বিদ্রোহী উভয়ের সঙ্গেই আলোচনার পরিকল্পনা করছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক সফর এই ইঙ্গিতই দেয়। মিয়ানমারের ডিসপ্রোসিয়াম, টার্বিয়াম ও ইট্রিয়ামের মতো হেভি রেয়ার আর্থ উপাদানগুলো সামরিক সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক যান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অপরিহার্য।
চ্যাথাম হাউজের গবেষক উইলিয়াম ম্যাথিউজ বলেন, “এই খাত চীনকে এমন নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্লাই চেইনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।” তার সহকর্মী প্যাট্রিক শ্রোডার মনে করেন, “দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকি এড়াতে অন্য দেশগুলো উৎপাদন চীনের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বদলে গেছে।”
আসিয়ান সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে হাস্যোজ্জ্বল থাকলেও, পর্দার আড়ালে বিরল খনিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়ান। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন তিনি, যা মার্কিন কোম্পানিগুলোকে নতুন খনি মজুদের ওপর বিনিয়োগ ও ক্রয়াধিকার দেয়। মালয়েশিয়ার চুক্তিতে এমন ধারা রয়েছে, যা ভবিষ্যতে খনিজ রপ্তানিতে কোটা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাধা দেবে।
অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও লাওস খনিজ খাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করছে। ইন্দোনেশিয়ায় গঠিত হয়েছে আলাদা খনিজ মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়া সংরক্ষিত অরণ্যে খনন নিষিদ্ধ রাখলেও বনভূমির বাইরে ১ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর এলাকায় নতুন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। পাহাংয়ের লিনাস কারখানাটি এশিয়ার একমাত্র রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র, যা বর্তমানে অস্ট্রেলীয় আকরিক প্রক্রিয়া করছে।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যৌথ অনুসন্ধান ও পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তিতে সহযোগিতা শুরু করেছে, আর ভিয়েতনামকে নতুন সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো কার্ল ফ্রিডহফ বলেন, “ওয়াশিংটন ৫০টিরও বেশি উপাদানকে ‘ক্রিটিক্যাল মিনারেল’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিনিয়োগ ও অংশীদারত্ব বাড়াচ্ছে, যাতে চীনের নিয়ন্ত্রিত চেইন থেকে নিজস্ব রিফাইনিং সক্ষমতা গড়ে তোলা যায়।”
সব মিলিয়ে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ঘিরে একটি নতুন খনিজ কূটনীতির মাধ্যমে চীনের প্রভাববলয় থেকে মুক্ত সাপ্লাই চেইন গড়ার কৌশলে এগোচ্ছে।

