যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহর নিউইয়র্কে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম রাজনীতিক জোহরান মামদানি। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জোহরান মামদানি গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিউইয়র্ক সিটির ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমো ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে পরাজিত করে ইতিহাস গড়েছেন তিনি। তিনি শহরটির প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন—যা একদিকে মার্কিন রাজনীতিতে বৈচিত্র্যের প্রতীক, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নতুন প্রজন্মের উত্থানকে সামনে এনেছে।
নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য লড়াই করছিলেন। তবে গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

৩৪ বছর বয়সী ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট ও কুইন্স থেকে নির্বাচিত অঙ্গরাজ্য পরিষদ সদস্য জোহরান ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন। ৬৭ বছর বয়সী কুমো পান ৪০ শতাংশের কিছু বেশি ভোট, আর স্লিওয়া ৭ শতাংশের কিছু বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ডেমোক্র্যাটদের একের পর এক সাফল্যের মধ্যে জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক এ জয় এসেছে। ভার্জিনিয়ায় কংগ্রেস সদস্য অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার অঙ্গরাজ্যের প্রথম নারী গভর্নর হচ্ছেন, নিউজার্সিতে গভর্নর পদে মিকি শেরিল ট্রাম্প-সমর্থিত প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গ্যাভিন নিউসমের নতুন আসনবিন্যাস পরিকল্পনায় ডেমোক্র্যাটদের জন্য পাঁচটি নতুন কংগ্রেস আসন যোগ হতে যাচ্ছে।
ব্রুকলিনের ব্রুকলিন প্যারামাউন্ট হলে জোহরানের বিজয় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন সমর্থকেরা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস তাঁর পক্ষে ফল ঘোষণা করতেই উপস্থিত জনতা চিৎকার, করতালি, আলিঙ্গনে মেতে ওঠেন।
নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার পাশাপাশি জোহরান শহরের ইতিহাসে প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও গত এক শতকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী মেয়র।
গত শরতে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরুর সময় জোহরান ছিলেন তুলনামূলক অচেনা রাজনীতিক। কিন্তু শহরের বসবাসযোগ্যতা নিয়ে তাঁর স্পষ্ট বার্তা ও প্রাণবন্ত প্রচার দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর ঘোষিত কর্মসূচিতে ছিল বাড়িভাড়া স্থির রাখা, সাশ্রয়ী আবাসন নির্মাণ, ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ৩০ ডলার করা, বাস পরিবহনসেবা ফ্রি করা, ধনীদের ওপর কর বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুদান, হাজারো স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক যোগাযোগে বুদ্ধিদীপ্ত প্রচার ও পরিবর্তনের বার্তা—সব মিলিয়ে জোহরানের তৃণমূল প্রচার বসন্ত নাগাদ গতি পায়। এ গতি চূড়ান্ত রূপ পায় গত জুন মাসে ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে। প্রাথমিক বাছাই ভোটে তিনি কুমোকে প্রায় ১৩ পয়েন্টে হারিয়ে নিউইয়র্কের রাজনৈতিক অভিজাত ব্যক্তিদের হতবাক করে দেন। তরুণ ও প্রথমবার ভোট দেওয়া নানা শ্রেণির ভোটারকেও একত্র করতে সক্ষম হন তিনি।
প্রাইমারিতে হারার পরও কুমো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থেকে যান। এক ডজনের বেশি নারীর কাছ থেকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর ২০২১ সালে গভর্নর পদ ছাড়েন কুমো। রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের আশা নিয়ে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচনে নামেন তিনি। তবে গ্রীষ্ম ও শরৎজুড়ে সব জরিপে জোহরান কুমো ও স্লিওয়ার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ইতিমধ্যে যৌন হয়রানির অভিযোগ নাকচ করেছেন কুমো।
অ্যান্ড্রু কুমোকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না-ও করতে পারেন, কিন্তু তাঁকে ভোট দেওয়ার বিকল্প নেই। আপনাকে অবশ্যই তাঁকে ভোট দিতে হবে। আশা করি, তিনি ভালো করবেন। তিনি সক্ষম, মামদানি নন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জোহরান ও কুমোর মধ্যে প্রায়ই তর্কবিতর্ক চলে নিজেদের কাজের রেকর্ড, যোগ্যতা, শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের ভাবনাসহ নানা ইস্যু ঘিরে। জোহরান অভিযোগ করেন, কুমো ধনী অনুদান দাতা ও করপোরেট স্বার্থে কাজ করেন। আর কুমো বলেন, জোহরান শহর পরিচালনায় অদক্ষ ও অভিজ্ঞতাহীন।
অক্টোবর মাসে মেয়র পদপ্রার্থীদের বিতর্কে জোহরান, কুমো ও স্লিওয়া শহরের অপরাধ, পুলিশিং, ইসরায়েল, আবাসন, পরিবহন, জীবনযাত্রার ব্যয়সহ নানা স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিক বিষয়ে মুখোমুখি হন। তাঁরা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও মতবিনিময় করেন।
জোহরান মামদানির প্রচার জাতীয় পর্যায়ে প্রগতিশীল নেতাদের সমর্থন পায়। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও নিউইয়র্কের কংগ্রেস সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ প্রকাশ্যে তাঁর পক্ষে প্রচারে অংশ নেন।
নিউইয়র্কের প্রভাবশালী আরো কয়েকজন নেতা, যেমন জেরি ন্যাডলার ও রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমসও জোহরানকে সমর্থন করেন। সেপ্টেম্বরে গভর্নর ক্যাথি হোকুল নীতিগত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও জোহরানের প্রতি তাঁর সমর্থনের ঘোষণা দেন। অতি সম্প্রতি, নির্বাচনের দুই সপ্তাহের কম সময় আগে প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যালঘু নেতা হাকিম জেফ্রিজ তাঁকে সমর্থন করার ঘোষণা দেন।
তবে নিউইয়র্কের সব ডেমোক্র্যাটই জোহরানের পাশে ছিলেন না। অঙ্গরাজ্যের দুই সিনেটর চাক শুমার ও কারস্টেন গিলিব্র্যান্ড তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেননি।
নির্বাচনী প্রচারের সময় জোহরানকে সমালোচনা ও আক্রমণের মুখে পড়তে হয় বয়স, অভিজ্ঞতা ও প্রগতিশীল নীতির কারণে। ইসরায়েল সরকারের নীতি ও গাজায় দেশটির আগ্রাসন নিয়ে সমালোচনা এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন তাঁর সঙ্গে কিছু ইহুদি গোষ্ঠীর সম্পর্ক জটিল করে তোলে।
জোহরান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রক্ষণশীল রাজনৈতিক মহলে ইসলামবিদ্বেষী আক্রমণেরও শিকার হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ও নিউইয়র্কের রিপাবলিকান প্রতিনিধি এলিস স্টেফানিক তাঁকে ‘মেয়র পদে জিহাদপন্থী প্রার্থী’ বলে আখ্যা দেন।

অক্টোবর মাসে জোহরান কুমোর তীব্র সমালোচনা করেন। কারণ, কুমো এক রক্ষণশীল রেডিও উপস্থাপকের সঙ্গে হাসাহাসি করছিলেন, যখন তিনি (উপস্থাপক) বলছিলেন, ‘আরেকটি ৯/১১ ঘটলে মামদানি নিশ্চয় উল্লাস করবেন।’ মামদানি এ ঘটনাকে ‘বীভৎস’ ও ‘বর্ণবাদী’ বলে আখ্যা দেন।
এর আগে কুমোকে সমর্থনকারী রাজনৈতিক সংস্থা ‘সুপার প্যাক’-এর বিরুদ্ধে জোহরান অভিযোগ তোলেন, তারা ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়েছে। একটি প্রস্তাবিত পোস্টারে তাঁর দাড়িকে বেশি কালো, লম্বা ও ঘন করে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক মনোযোগ কেড়েছে। এ নিয়ে রাজনীতিক ও বিশ্লেষকেরা নানা মত দিয়েছেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও হস্তক্ষেপ করেছেন। মামদানিকে ‘চরমপন্থী’ ও ‘কমিউনিস্ট’ বলে আখ্যা দিয়ে কুমোকে সমর্থন জানিয়েছেন।
এমনকি ভোটের আগের দিন গত সোমবার সন্ধ্যায় ট্রাম্প বলেছেন, জোহরান জিতলে নিউইয়র্ক প্রায় কোনো ফেডারেল তহবিল পাবে না। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘অ্যান্ড্রু কুমোকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না–ও করতে পারেন, কিন্তু তাঁকে ভোট দেওয়ার বিকল্প নেই। আপনাকে অবশ্যই তাঁকে ভোট দিতে হবে। আশা করি, তিনি ভালো করবেন। তিনি সক্ষম, মামদানি নন।’
ট্রাম্পের এককালের ঘনিষ্ঠ মিত্র ধনকুবের ইলন মাস্কও সোমবার নিউইয়র্কবাসীকে কুমোকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান।
উগান্ডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরিবারে জন্ম নেওয়া জোহরান সাত বছর বয়সে পরিবারসহ নিউইয়র্কে আসেন। তিনি ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পান। জুলাইয়ে ট্রাম্প তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করার ইঙ্গিত দেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি শুধু আমাদের গণতন্ত্রের ওপর আঘাত নয়; বরং যাঁরা ভয় না পেয়ে সত্য কথা বলেন বা সাহস দেখান, সেই প্রত্যেক নিউইয়র্কবাসীর প্রতি এ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা যে যদি আপনি কথা বলেন, তাঁরা আপনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন।’
সব আক্রমণ উপেক্ষা করেও জোহরানের প্রচার দেশজুড়ে প্রভাব ফেলেছে। আগস্টে দ্য গার্ডিয়ান জানায়, তাঁর প্রচার অন্তত ১০ হাজারের বেশি তরুণ প্রগতিশীলকে রাজনীতিতে আসার কথা ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে স্থানীয় সময় গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় আজ বুধবার ভোর পাঁচটা) আনুমানিক ১৭ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছেন বলে জানায় শহরের নির্বাচন বোর্ড। গত ৩০ বছরের মধ্যে এটি ছিল সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি।
১৯৯৩ সালের নির্বাচনে প্রায় ১৯ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী রুডি জুলিয়ানি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ডেভিড ডিনকিনসকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচনে প্রায় ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ জন আগাম ভোট দিয়েছেন, যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচনে নিউইয়র্ক শহরে এটিই সর্বোচ্চ আগাম ভোট পড়ার ঘটনা।
গতকাল নিউইয়র্ক শহরের অ্যাস্টোরিয়া এলাকায় একটি কেন্দ্রে ভোট দেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান মামদানি। নির্বাচনে অন্যান্য প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোরও অঙ্গীকার করেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই তরুণসহ সব বয়সী ভোটারের মধ্যে বেশ সাড়া পেয়েছেন, যার প্রতিফলন দেখা গেছে গতকালের ভোটকেন্দ্রে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস্, এপি, এফপি, ওয়াসিংটন পোস্ট, এনডিটিভি/সূত্র: প্রথম আলো

