প্রায় সাত দশক ধরে পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়ের অংশ ছিল পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স—সংক্ষেপে পিআইএ। কিন্তু সেই অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে চলতি সপ্তাহে সরকার ৪৮ কোটি ২০ লাখ ডলারে বিমান সংস্থাটির ৭৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছে। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত এই নিলামকে সরকার ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে দেখালেও, বিরোধী রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি ও সামরিক প্রভাব—সব মিলিয়ে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক।
ইসলামাবাদে আয়োজিত এই নিলামে বিজয়ী হয় করাচিভিত্তিক আরিফ হাবিব লিমিটেডের নেতৃত্বাধীন একটি কনসোর্টিয়াম। এতে রয়েছে একে ডি গ্রুপ হোল্ডিংস, ফাতিমা ফার্টিলাইজার, সিটি স্কুলস এবং লেক সিটি হোল্ডিংস। পরে এই কনসোর্টিয়ামে যোগ দেয় সামরিক মালিকানাধীন ফৌজি ফার্টিলাইজার কোম্পানি—যা পুরো চুক্তিকে আরও বেশি সংবেদনশীল করে তোলে।
১৯৫৫ সালে যাত্রা শুরু করা পিআইএ একসময় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার গর্ব। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা—বিশ্বজুড়ে ছিল এর ফ্লাইট। এমনকি এমিরেটস এয়ারলাইন্স গড়ে ওঠার পেছনেও পিআইএর অবদান রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও আর্থিক লোকসানে ডুবে যেতে থাকে এই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পিআইএর দায় দাঁড়ায় প্রায় ১৭০ কোটি ডলার, আর দীর্ঘমেয়াদি দায় ছাড়িয়ে যায় ২৩শ কোটি ডলার। একসময় যেখানে ৫০টির বেশি উড়োজাহাজ ছিল, এখন কার্যকর রয়েছে মাত্র ১৮টি। কর্মীর সংখ্যাও কমে এসেছে ৭ হাজারের নিচে।
এর ওপর ২০২০ সালে করাচিতে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে নিষেধাজ্ঞা পায় পিআইএ। প্রায় চার বছর পর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও, ততদিনে আন্তর্জাতিক বাজারে সংস্থাটির অবস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নিলামে তিনটি পক্ষ অংশ নেয়। নির্ধারিত ন্যূনতম দামের নিচে প্রস্তাব দেওয়ায় শুরুতেই বাদ পড়ে বেসরকারি বিমান সংস্থা এয়ার ব্লু। শেষ পর্যন্ত আরিফ হাবিবের কনসোর্টিয়াম ৪৮২ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিয়ে বিজয়ী হয়।
সরকার জানিয়েছে, এই অর্থের প্রায় ৯২ শতাংশ আবার পিআইএর মধ্যেই বিনিয়োগ হবে। নগদ হিসেবে সরকারের হাতে আসবে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন ডলার, আর বাকি ২৫ শতাংশ শেয়ার সরকারের কাছেই থাকবে। নতুন মালিকপক্ষ ভবিষ্যতে সেই অংশও কিনে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এই কাঠামো তৈরি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল—আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী। পাকিস্তান বর্তমানে আইএমএফের ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে এবং লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিক্রি তার একটি বড় শর্ত।
বিরোধী দল ও জোটগুলোর অভিযোগ, জনগণের মতামত ও সংসদের যথাযথ তদারকি ছাড়াই একটি জাতীয় সম্পদ বিক্রি করা হয়েছে। ইমরান খানের দল পিটিআই নেতৃত্বাধীন জোট বলছে, এই বেসরকারিকরণ সাংবিধানিক ও নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে।
অনেকে আরও প্রশ্ন তুলেছেন—আসলে কি সরকার মাত্র ৩৬ মিলিয়ন ডলারে ৭৫ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে? কারণ বাকি অর্থ তো আবার সেই বিমান সংস্থাতেই বিনিয়োগ হচ্ছে, যার লাভ শেষ পর্যন্ত নতুন মালিকরাই পাবে।
সরকার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছে, লোকসান বন্ধ করাই ছিল মূল লক্ষ্য, লাভ করা নয়।
সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে ফৌজি ফার্টিলাইজার কোম্পানির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। এটি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পরিচালিত ফৌজি ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিষ্ঠান। ফলে অনেকের আশঙ্কা—পিআইএ কি সত্যিই বেসরকারি হলো, নাকি এক সরকারি হাত থেকে আরেক সরকারি হাতে গেল?
বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক উপস্থিতি একদিকে বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, অন্যদিকে বাজারে প্রতিযোগিতার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি করে। বিশেষ করে অন্য বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর জন্য এটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি হতে পারে।
দুই দশকের ব্যর্থতার পর পিআইএ বেসরকারিকরণ নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা। কেউ একে প্রয়োজনীয় সাহসী সিদ্ধান্ত বলছেন, কেউ আবার রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
একটি বিষয় স্পষ্ট—এই চুক্তি শুধু একটি বিমান সংস্থা বিক্রির গল্প নয়। এটি পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনার প্রতিফলন। পিআইএর নতুন যাত্রা সফল হবে কি না, তার উত্তর দেবে সময়।

