একটি ছোট্ট গ্রামে ছিল মৃদুল নামের একজন তরুণ। তার বয়স মাত্র কুড়ি কিন্তু সে ছিল সাহিত্যের প্রতি গভীর আকর্ষণী। গ্রামের পুস্তকাগার থেকে বই সংগ্রহ করে পড়া, লেখা-এসবই ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। তবে তার মনে ছিল এক প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্য কিভাবে এতো পরিবর্তিত হলো?
একদিন মৃদুল তার দাদা, যিনি গ্রামে একজন প্রবীণ সাহিত্যিক, তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল “দাদা বাংলা সাহিত্যের আধুনিকায়ন কীভাবে ঘটেছিল? কেন ঊনিশ শতক এত গুরুত্বপূর্ণ?”
দাদা মৃদুলকে ডাকলেন এবং বললেন, “চল, আমি তোমাকে একটা গল্প বলি।”
সেই গল্পের শুরু-
ঊনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল। ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটছিল। তখন কলকাতায় নতুন নতুন স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। মানুষ ইংরেজি শিক্ষা নিতে শুরু করেছিল, আর এর ফলে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছিল।
দাদা বললেন, “তুমি জানো, এখনকার সাহিত্য ও সংস্কৃতির পথচলা শুরু হয়েছিল তখন। সেই সময়ের নবজাগরণের ফলে অনেক লেখক সমাজের সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন।”
“নবজাগরণ?” মৃদুল জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, যেমন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ধর্ম ও রাজনৈতিক চিন্তার সমন্বয় ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি এবং জীবনযাপন এক নতুন রূপ নিয়েছিল,” দাদা বললেন।
“ঠিক!” মৃদুল বলল। “সেখানে কি সমাজের পরিবর্তন ছিল?”
“অবশ্যই! দেখো, বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। তিনি নারীর শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেই সময়ের লেখকরা নারীদের অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। এই সামাজিক পরিবর্তনগুলো সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছিল,” দাদা বললেন।
বাস্তবতা ও রোমান্টিসিজম-
মৃদুলের মনোযোগ আরও বাড়ছিল। “আর বাস্তববাদ?” সে জানতে চাইল।
“অভিজ্ঞান শাকুন্তলম, মহাভারত, এসব থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তার গল্পগুলোতে দরিদ্রতা, সম্পর্কের জটিলতা এবং সমাজের নানা দিক ছিল। আর কাজী নজরুল ইসলাম যিনি বিদ্রোহী কবি, তার রচনায় নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেত।”
“রবীন্দ্রনাথ তো অসাধারণ! তার রোমান্টিক কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির মিলন কত সুন্দর!” মৃদুল মন্তব্য করল।
“একদম ঠিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় রোমান্টিসিজমের যে ছোঁয়া ছিল, তা বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল,” দাদা বললেন।
সমাজের প্রতিবিম্ব-
“তাহলে, সাহিত্যের এই পরিবর্তন সমাজের প্রভাবেই তো হয়েছে?” মৃদুল জানতে চাইলো।
“অবশ্যই! সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের জটিলতা, অসঙ্গতি এবং পরিবর্তন ঘটছিল। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকায়ন কেবল একটি সাহিত্যিক পরিবর্তন নয় বরং এটি সামাজিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বও করে,” দাদা বললেন।
মৃদুল গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল। দাদার কথাগুলো তার মনে গেঁথে যাচ্ছিল। “তাহলে, আমাদের সাহিত্য কি আমাদের ইতিহাসের প্রতিফলন?”
“একদম! সাহিত্যের এই ইতিহাস আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি প্রেরণা,” দাদা বললেন।
দাদা বললেন, “বাংলা সাহিত্য কেবল একটি শিল্প নয় বরং এটি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই, লেখালেখি এবং সাহিত্য চর্চা আমাদের দায়িত্ব। যে সময়ের সাহিত্যের ভেতর দিয়ে আমরা সমাজের পরিবর্তন দেখেছি, তা আমাদের নিজেদের ভাবনার জন্য উদ্দীপনা।”
মৃদুল তখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল, সে সাহিত্য চর্চা করবে এবং সমাজের পরিবর্তনে তার হাতও লাগাবে। দাদা যে গল্প বলেছিলেন, তা ছিল শুধু একটি ইতিহাসের কথা নয় বরং তার নিজের ভবিষ্যতের একটি নির্দেশনা।
এভাবেই, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকায়ন মৃদুলের মনে নতুন জ্বালানি জোগালো, একটি সাহিত্যিক যাত্রার শুরু হল।