পদ্মার তীর ঘেঁষে ছোট্ট জেলে পল্লীর বাসিন্দা কুবের। কুবেরের জীবন দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ, তবে এই দুঃখ কোনো দমে থাকার নয়। ছোট্ট ঘর, বউ-মেয়ে আর দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পদ্মার বুক চিরে মাছ ধরাই তার জীবিকা। তবে নদী যে কেবল তার উপার্জনের মাধ্যম, তা নয়। বরং তার জীবনসঙ্গী।
নদীর সাথে কুবেরের জীবনের গভীর সম্পর্ক। কখনো নদী মৃদু স্রোতে শান্ত, আবার কখনো তার উত্তাল রূপ দেখে মনে হয় যেনো কুবেরের দুঃখ-বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করতে চাইছে। নদীর কোলেই যেন কুবের তার ভালোবাসা আর আশ্রয় খুঁজে পায়। কিন্তু পদ্মা নদীর মাঝে মাঝে এমনও মেজাজ দেখায় যে কুবের আর তার সাথীরা বুঝতেই পারে না, নদী তাদের মিত্র, না প্রতিপক্ষ।
দিনগুলো চলে যায় একঘেয়ে কষ্টের মধ্যে। মাছ ধরেও যে তেমন কিছু আয়ে করতে পারে না কুবের, তবে কিছুতেই সে হাল ছাড়ে না। কিন্তু কুবেরের মনে সব সময় একটা অজানা আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। সে চায় এই দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি। সে চায় নতুন একটা জীবন—একটা অজানা জীবন, যা এই পদ্মার পাড়ে থাকে না। কিন্তু কোথায় সেই জীবন? কার কাছে গেলে সে এই মুক্তি পাবে?
একদিন কুবের শুনতে পায় কাছের এক গ্রামে হোসেন মিয়া নামে এক লোক নতুন একটা জায়গায় বাসা বাঁধছে। নাকি সেই জায়গাটা দুনিয়ার থেকে আলাদা। যেখানে মানুষ সুখে থাকে, যেখানে নেই কোনো অভাব, নেই কোনো দুঃখ-কষ্ট। কথাটা শুনে কুবেরের মন কেমন যেন করে ওঠে।
সন্ধ্যার পর পদ্মার তীরে বসে কুবের তার চিরচেনা মাঝিদের সঙ্গে গল্প করে। কিন্তু আজ তার মনে শান্তি নেই। তাকে যেন কিছু একটা ডাকে। এই জীবন, এই নদী, এই পাড় ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার একটা আকাঙ্ক্ষা তার মনের গভীরে ঝড় তুলে দেয়।
পরদিন কুবের হোসেন মিয়ার কাছে যায়। গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “আমারে নিবা মাঝি লগে?”
কুবেরের এই প্রশ্নে হোসেন মিয়া কিছুটা থমকে যায়। কুবেরের চোখে সে এক ধরনের আবেগ আর তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখতে পায়। এ যেন মুক্তির ডাক, এক নতুন জীবনের সন্ধান। কুবেরের এই আকুল ডাকে হোসেন মিয়া কুবেরকে সঙ্গ দিতে রাজি হয়। কিন্তু তার সাথে কুবের জানে না, নতুন গন্তব্যে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।
নৌকায় চড়ে কুবের সেই নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পদ্মার স্রোত যেমন অনিশ্চিত, তেমনি তার এই যাত্রার ভবিষ্যৎও অজানা। তবে কুবেরের মনে শান্তি। তার বিশ্বাস, যে জায়গায় যাচ্ছে, সেখানে কোনো কষ্ট নেই। নদীর বুকে ভেসে চলার মাঝে তার মনে এক ধরনের আশ্রয়ের অনুভূতি জাগে।
পদ্মার স্রোত তাকে নিয়ে যায় এক অনিশ্চিত গন্তব্যে। হয়তো সেখানে তার কষ্টের অবসান হবে, হয়তো আবার নতুন দুঃখ শুরু হবে। তবে কুবেরের মনে তবু একটা শান্তির প্রতিধ্বনি-সে জানে না, ঠিক কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু এই যাত্রাই তার জন্য মুক্তি হয়ে উঠেছে।
শেষমেষ, কুবেরের এই যাত্রাই হয়ে ওঠে তার জীবনের সেই পরম সত্য। পদ্মার মাঝি কুবেরকে জীবন থেকে পালানোর পথ না দিলেও, জীবনের গভীরতম বোধ ও সম্পর্কের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। তার কণ্ঠে আবারো সেই কথাটি ফিরে আসে- “আমারে নিবা মাঝি লগে??”
এই প্রশ্নের উত্তর না জানা থাকলেও কুবের নিজের জীবনের সঙ্গে যেন এক হয়ে যায়।