আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-এক বিস্ময়কর সাহিত্যিক, যার রচনায় প্রতিফলিত হয় মানুষের অস্তিত্বের চরম দ্বন্দ্ব, গভীর শূন্যতা এবং যুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। তার সাহিত্য যেন এক গভীর দার্শনিক যাত্রা, যেখানে চরিত্রেরা জীবনের অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হয়, আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে জর্জরিত হয় এবং পরিণামে বুঝতে শেখে অস্তিত্বের প্রান্তসীমা। হেমিংওয়ে নিজের জীবন থেকে যুদ্ধের নির্মমতা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এবং সেই অভিজ্ঞতার জারিত বোধ তার প্রতিটি সৃষ্টিতে ঢেলে দিয়েছেন-এমন এক সুরে যা তাকে সাহিত্যজগতে অমরত্ব দিয়েছে।
একটি বিদায়ী চিঠি বা A Farewell to Arms হেমিংওয়ের এমনই এক অনন্যসাধারণ রচনা, যেখানে যুদ্ধ ও প্রেম যেন একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফ্রেডরিক হেনরি-এক তরুণ চিকিৎসক, যিনি বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত, তবু নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন প্রেমের আশ্রয়ে। যুদ্ধের অন্ধকারে জীবনকে খুঁজতে থাকা ফ্রেডরিক হেনরির ভেতর দিয়ে হেমিংওয়ে এক অবিস্মরণীয় বার্তা দেন-যুদ্ধ মানুষকে কীভাবে শূন্যতা ও বিষণ্ণতার গভীর অতলে টেনে নিয়ে যায়, আবার প্রেম সেই শূন্যতা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হলেও কীভাবে জীবনকে কিছুটা অর্থ দেয়। এই গল্পে, প্রেম এক পলক আলো দেয়, কিন্তু যুদ্ধের ছায়া তাতে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, আর সেই সাথে হেনরির মনে প্রশ্নের উদয় হয়-জীবনের প্রকৃত অর্থ কী?
কিন্তু হেমিংওয়ের প্রকৃত মহিমা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার রচনা দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি তে। এই কাহিনিতে তিনি জীবনের গভীর সৌন্দর্য এবং চূড়ান্ত একাকীত্বকে অতি সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বৃদ্ধ স্যান্টিয়াগো, যে সমুদ্রের মাঝে বিশাল এক মাছের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তাকে আমরা কেবল একজন বৃদ্ধ নয় বরং অস্তিত্বের সন্ধানে রত এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে পাই। হেমিংওয়ে তার লেখনীতে এই সংগ্রামকে এক অনন্য ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে স্যান্টিয়াগো একদিকে অমোঘ পরাজয়ের সামনে, আর অন্যদিকে এমন এক আত্মবিশ্বাসে আচ্ছন্ন যা তাকে জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্যের সন্ধান দেয়। তার প্রতিটি হ্রাস ও জয় যেন মানবজাতিরই প্রতিচ্ছবি।
হেমিংওয়ের লেখায় ভাষার পরিমিত ব্যবহার, সংলাপের স্পষ্টতা এবং গভীর আত্মিক অনুভব একত্রিত হয়ে যে সাহিত্যিক সুর তৈরি করে তা সত্যিই অতুলনীয়। হেমিংওয়ে তার সংক্ষিপ্ত বাক্যগঠনের মাধ্যমে পাঠকের হৃদয় ও মনের গভীরে এমন চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে, যা জীবনের প্রতিটি স্তরের জটিলতা অনুভব করতে বাধ্য করে। তার সাহিত্যে অস্তিত্ববাদের অনুষঙ্গ প্রবলভাবে দৃশ্যমান-যেখানে মানুষ বেঁচে থাকার অর্থের সন্ধানে অনবরত সংগ্রাম করছে, এমনকি কখনো কখনো নিজের ভেতরই সেই অর্থ হারিয়ে ফেলছে। হেমিংওয়ে হয়তো তার গল্পের চরিত্রদের নির্দিষ্ট কোনো দিশা দেন না, তবু এই দিশাহীনতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সেই জীবনসংগ্রাম, যা মানবসভ্যতাকে অগ্রসর করে।
হেমিংওয়ের গল্পগুলো শুধু যুদ্ধ ও অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নই নয় বরং তিনি যেন আমাদের প্রত্যেককে জানান দেন—জীবন হলো এক অদম্য লড়াই, যেখানে কোনো স্থায়ী সমাধান নেই কিন্তু লড়াইয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকে জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য। তার লেখনী আমাদের শিখিয়ে যায় কীভাবে জীবনের বিপদসঙ্কুল পথে এগিয়ে যেতে হয়, অন্তর্গত প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে হয় এবং অবশেষে উপলব্ধি করতে হয় অস্তিত্বের শূন্যতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য।