[গুসতাবো আনদ্রাদে রিবেরা জন্মেছেন ১৯২১ সালে কলম্বিয়ার উইলা প্রদেশের রাজধানী নেইবাতে। ছোটো এবং কম জনবহুল এই শহরে রিবেরা কাটিয়েছেন তাঁর জীবনের প্রথম আটত্রিশটি বছর—এই সময়ের তাঁর প্রায় সব লেখালিখি ছাপা হয় স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে। প্রাদেশিক রাজধানীর বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ব তার জীবনে অস্থিরতার জন্ম দেয় এবং বড় কিছু করার স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং এনে তোলে বোগোতাতে—হাতে টাকা নেই, নেই কোনো কাজও। এখানেই তিনি প্রথম থিয়েটারের দিকে ঝোঁকেন। কিছু ছোটোগল্প ও সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখলেও কলম্বিয়ান সাহিত্যে রিবেরার প্রধান অবদান নাটকে, বিশেষ করে একাঙ্ক নাটকে। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে এল অম্বরে কে বেনদিয়া টালেনতো (১৯৫৯), য়িসতোরিয়াস পারা কুইতার এল মুয়েদো (১৯৬১), রেমিংটন ২২ অন্যতম। রেমিংটন ২২ সংলাপ-প্রধান নয়-দর্শকের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য যেটুকু সংলাপ না হলেই না, কেবল সেটুকুই ব্যবহার করেছেন তিনি। ক্ষমতার মোহ ও লোভ, মানুষের অমানবিকতা ইত্যাদির প্রতি নাট্যকারের অপরিসীম ক্রোধ যেন ভাষাহীন বিভিন্ন ধরনের মূকাভিনয়ের মাধমে আরও প্রকট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে এই নাটকে। রিবেরা মারা যান ১৯৭৪ সালে।]
চরিত্র
মা
বাবা
গ্রিনগো
পাপেট গুসতাবুস
পাপেট খেওরখে
পাপেট ইসিদর
পাপেট সরকারি কর্মচারী
পাপেট আলোকচিত্রী
পাপেট ঘোষক
পাপেট কালো পোশাকের দেবদূত
পাপেট সাদা পোশাকের দেবদূত
পাপেট সাদা-কালো পোশাকের দেবদূত
পাপেট পুরো পোশাকের দেবদূত
পাপেট নীল পত্রিকা বিক্রেতা
পাপেট লাল পত্রিকা বিক্রেতা
পাপেট গুন্ডা-তিনজন
পাপেট সাইকেল আরোহী-তিনজন
পাপেট নীল প্রতিবেশী, কয়েকজন—সব লিঙ্গের
পাপেট রানি
পাপেট কৃষক-কয়েকজন-শিশু এবং বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ
এছাড়া সত্যি পাপেট-অর্থাৎ ন্যাকড়া ও খড় দিয়ে তৈরি কৃষক ও শিশুদের আদলে তৈরি পাপেট।
দৃশ্যপট
কালো পর্দা-না দেয়াল নির্দেশ করবে, না দরজা কিংবা জানালা। মঞ্চের মাঝামাঝি পেছনের অংশে দুইটা কফিন। একটার ওপর নীল পতাকা, অন্যটার ওপর লাল। দুইটার ওপরই দুইটা বড় ফুলের স্তবক। দুইটা স্তবকের সাথে লাগানো কালো সিল্কের কাপড়—একটাতে বড় করে লেখা গুসতাবুস; অন্যটায় খেওরখে। আপন ভাই দুজন। মোমবাতি জ্বলছে—আর কোনো আলো না থাকলেও চলবে আপাতত। দুই কফিনের মাঝে রাখা দুইটা বেতের তৈরি চেয়ার।
পর্দা উঠলে আমরা ‘বাবা’—‘মা’কে দুই চেয়ারে বসে থাকতে দেখি। মনে রাখতে হবে ‘বাবা’ ‘মা’ ও ‘গ্রিনগো’ পাপেট নয়—সত্যি চরিত্র। ‘বাবা’-‘মা’ যেন দুঃখের প্রতীক—সব শেষ হয়ে গেছে তাদের; দুই সন্তানের মৃত্যু। মায়ের হাতে তসবি-ধীরে আঙুল চলে, ঠোঁট নড়ে। ঢং ঢং করে আটবার ঘণ্টা বাজলে নীরবতাটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সেই সাথে দূরের গির্জা থেকে শেষকৃত্যের ঘণ্টাধ্বনিও শোনা যায়।
প্রতিবেশীরা আসতে শুরু করে। পাপেট নীল প্রতিবেশী : আগাগোড়া নীল পোশাক পরা—ডানপাশ দিয়ে ঢোকে। পাপেট লাল প্রতিবেশী : আগাগোড়া লাল পোশাকে—বামপাশ দিয়ে ঢোকে। দুইটা পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে বিদ্বেষ, ঘৃণা ও ভয় নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকায়। দুই পক্ষ দুই কফিনকে ঘিরে দাঁড়ায়। নীলরা নীল পতাকাওয়ালা কফিনকে ও লালরা লাল পতাকাওয়ালা কফিনকে ঘিরে। টানটান উত্তেজনা। চরম অস্বস্তি যখন দুই পক্ষ মারমুখী ভঙ্গিতে মুখোমুখি হয়। এরপর পালাক্রমে (অর্থাৎ একজন নীল, একজন লাল, একজন নীল… এভাবে) তারা বাবা-মার কাছে গিয়ে শোক প্রকাশ করে। পাপেট প্রতিবেশীদের এইসব নির্বাক কর্মকাণ্ডের মধ্যেও বাবা-মা যেন অনেকটা নির্লিপ্ত থাকতে পারে—এমন একটা নিবিড় দুঃখবোধ যেন এইসব তাদের স্পর্শ করে না। শোক-জ্ঞাপন পর্বে লাল-নীল প্রতিবেশীরা একে অপরকে ধাক্কা মারে, গুঁতা মারে, একে অপরের পথরোধ করে, জিভ প্রদর্শন করে ইত্যাদি। অবশেষে যেভাবে এসেছিল সেভাবে বের হয়ে যায়। শেষকৃত্যের মিউজিক বেজে ওঠে। অন্ধকার আরও গাঢ় হয়। মোমবাতির শিখা কেঁপে ওঠে—যেন এখনই নিভে যাবে। শেষকৃত্যের ঘণ্টাধ্বনি।]
প্রথম তরঙ্গ
মা : আটটা তিরিশ?
বাবা : [নীরবতা। বেশি দীর্ঘ নয় যে নীরবতাই প্রধান হয়ে ওঠে আর বেশি ছোটোও নয় যে এর নাটকীয়তাটুকু খর্ব করে। এই নিয়ম এই কথোপকথনের সব বিরতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য] আটটা তিরিশ।
মা : আগামীকাল… অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া?
বাবা : হ্যাঁ… কাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।
মা : কখন?
বাবা : পাদরি বললেন এগারোটা
মা : কিছু কি… ঘটবে?
বাবা : তেতে আছে দু-পক্ষই-নীলরা গুসতাবুস-এর মৃত্যুতে, লালরা খেওরখের মৃত্যুতে… ভয় তো হচ্ছেই… কিছু একটা ঘটবে।
মা : [উঠে] আরও মৃত্যু! আরও মৃত্যু… কীভাবে শুরু হলো এসব?
বাবা : [উঠে] কীভাবে শুরু হলো? [বিরতি] নদীর শুরু কী করে হয়? একটা ফুলে ফেঁপে ওঠা নদী যে তর্জন গর্জন করে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায় টেনে নিয়ে তোমাকে ও তোমার সবকিছুকে, কী করে তার জন্ম হয়? একটা ঝরনা, পর্বতের গর্তে যার উৎস লুকিয়ে আছে, সে কী করে জানবে একদিন উপত্যকায় কী ধ্বংস-উচ্ছেদ-মৃত্যু সে ঘটাতে যাচ্ছে? কেমন করে শুরু হলো?… কী করে এর শেষ হবে বরং সেটা জানতে আমি বেশি আগ্রহী… কীভাবে এর শেষ আসবে…
মা : কী করে এর শেষ হবে আমার কাছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না… কারণ সব শেষ হয়ে গেছে আমার… আমাদের… সব শেষ…
বাবা : আমার মনে হয় এর শুরুটা…
মা : [রেগে] শেষ! শেষ! আমি বলছি সব শেষ! শুনতে পাচ্ছ না তুমি? ওই দেখো [কফিন দেখায়] কীভাবে শেষ হয়েছে! তবু আমি জানতে চাই [শান্ত হয়ে] কীভাবে এসবের শুরু হলো। আমি জানতে চাই কী পাপ আমরা করলাম এবং কখন নয়তো কেন এই শাস্তি! [‘বাবা’কে সরাসরি] তুমি করেছ কোনো পাপ?
বাবা : নদী কিন্তু তার উৎসে ফেরে না… যতক্ষণ না মেঘ তৈরি হয়, মেঘ থেকে বৃষ্টি…
মা : একদম হেঁয়ালি করবে না—আমি তোমার নদী নই, আমি মা এবং ঈশ্বরের নামে বলছি… না-না আমার দুই মৃত ছেলের নামে বলছি—মা, একজন ভালো মা কীভাবে হতে হয় আমি জানতাম, এখনও জানি।
বাবা : আর আমি…?
মা : তুমিও ভালো বাবা ছিলে… এবার ভালোয়-ভালোয় বলো কীভাবে এর শুরু হলো? বলো! তুমি জানো কারণ তুমি পুরুষ… কারণ এইসব পুরুষদের খেলা—
বাবা : নীলেদের থেকে লালেরা আলাদা কোথায় বলো তো?
মা : নীল? নীলেরা খারাপ, জঘন্য। তারা নীল পোশাক পরে ঘোরে, সাথে নীল পতাকা উঁচানো, চিৎকার-গলাবাজি করে, গালি দেয় লালদের, সমস্ত শরীর সশস্ত্র, খুন করে—করতেই থাকে… যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই নিহত সন্তানদের একজন হয় আমাদের খেওরখে [সে ছুটে গিয়ে খেওরখের কফিন আঁকড়ে কাঁদে]
বাবা : আর লালরা?
মা : [এবার গুসতাবুসের কফিন আঁকড়ে] ওরাও খারাপ, জঘন্য। ওরা লাল পোশাক পরে ঘোরে, সাথে লাল পতাকা, চিৎকার-গলাবাজি করে, গালি দেয় নীলেদের, সমস্ত শরীর সশস্ত্র, খুন করে—করতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই নিহত সন্তানদের একজন হয় আমাদের গুসতাবুস [কফিন আঁকড়ে কাঁদে]
বাবা : অথচ বিশ বছর আগে… তুমি কি জানতে কীভাবে নীল থেকে লাল আলাদা করতে হয়?
মা : [মাথা তোলে, এই প্রশ্নে বিস্মিত] না…
বাবা : আমিও না। এই পার্থক্যটুকু আমি কখনো ধরতে পারিনি। ধরো আমার বন্ধু রোক্কো আর ইসিদর-বিশ বছর আগে ওরা কী করত?
মা : [আরও বেশি বিচলিত] কী আর করত… কী আর… গুড ফ্রাইডের শোভাযাত্রায় ইসিদরের হাতে থাকত পেড়েকের ঝুড়ি আর… রোক্কো নিয়েছিল যিশুর কাঁটার মুকুট… এই তো… আর রোক্কোর রক্ষক সেইন্ট রোক্কোর উদযাপন অনুষ্ঠানে হাই ম্যাস, আতশবাজি ইত্যাদির খরচ দিত আমাদের রোক্কো, অন্যদিকে সেইন্ট ইসিদরের অনুষ্ঠানের দিন এইসবের সব খরচ দিত আমাদের ইসিদর—এই তো!
বাবা : হ্যাঁ, লাল-নীলের যে দ্বন্দ্বের কথা বলছি, তখন পর্যন্ত তা ছিল কে বেশি মাড় দেয়া জামা পরে শোভাযাত্রায় গেছে, কে কার রক্ষক সেইন্টের অনুষ্ঠানে কত বেশি আতশবাজি পুড়িয়েছে ইত্যাদির মধ্যে। কয়েক বছর পরে কী হলো? গির্জার প্রাঙ্গণেই একজন আরেকজনকে গুলি করে ফৌত হলো—সাথে লাল-নীলের উভয় পক্ষের আরও পনেরোজন ‘শহিদ’-আর স্লোগানে লাল দল জিন্দাবাদ, লাল দল মুর্দাবাদ, নীল দল জিন্দাবাদ, নীল দল মুর্দাবাদ… লালদের লাল হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, নীলদের নীল হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও ইত্যাদি ইত্যাদি…
মা : এসবে আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।
বাবা : তুমি আসলেই জানতে চাও কীভাবে শুরু হলো এসব?
মা : হ্যাঁ, চাই।
বাবা : তোমার মনে হয় তুমি তাতে শান্তি পাবে?
মা : শান্তি না পেলেও।
বাবা : তোমার ভালো লাগবে না, ব্যথা বাড়বে।
মা : এর চেয়ে আর কী বেশি ব্যথা হতে পারে?
বাবা : তাহলে আমাদের ছেলেদের পরিচয় দাও এবার—মানে কী ছিল ওরা?
মা : [একটু ভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয়] কী আবার পরিচয়! আমার ছেলেরা ছিল ভালো… চমৎকার… অসাধারণ… গুসতাবুস [তার কফিনটার কাছে গিয়ে আদর করে যেন এটা গুসতাবুসের দোলনা বা গুসতাবুস নিজেই] কী সুন্দর লম্বা আর ছিপছিপে ছিল… ওর ছিল… মনে পড়ে তোমার… পায়ের দুটো আঙুলে ওর নখই ছিল না প্রায়? [সুন্দর করে হাসে]… খেওরখে… [তার কফিনের কাছে গিয়ে একইভাবে আদর করে হাত বুলায়] কিছুটা ছোটোখাটো আর গাট্টাগোট্টা… মনে আছে ওর যখন হাম হলো? রুমেই থাকতে চাইত না, হাম শুকালে মুখে গোটা-গোটা দাগ পড়ে গেল এমন… কিছুতেই সে দাগ গেল না পুরোপুরি! [হাসে, এবার একটু শব্দ করেই]
বাবা : [নিজেও এই স্মৃতিচারণের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়] সেবার গুসতাবুস বাথটাবে পড়ে গেল মাথা নিচে দিয়ে, ডুবতেই বসেছিল প্রায়… এরপর থেকে বাথটাব দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়।
মা : হ্যাঁ-হ্যাঁ, তুমি অনেক দ্রুতই ওকে টেনে তুললে… তেমন একটা পানি-টানিও খায়নি।
বাবা : সেই মূর্খ ও পাষণ্ড ডাক্তারটা কী করেছিল ভাবো এবকার! আমার খেওরখের হাতটাই শেষ হয়ে যাচ্ছিল সেবার! শনিবার হাত ভাঙল… শনিবার বিকালে, না? আর সোমবারের আগে সে ব্যাটা অপারেশনই করতে চাইল না—সোমবার তো হাত ফুলে ঢোল, কী বিশ্রী রকম বেগুনি হয়ে গেল ফুলে-টুলে…
মা : ইশ! পচন ধরে গেছিল প্রায়-লেডি লউরদেস সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলো; তার পানি-পড়া কী বিস্ময়কর কাজই না করল… একদিনেই ফোলা অনেকখানি কমে গেল…
বাবা : ওরা বড় হয়ে গেল, বলো…
মা : হ্যাঁ, বড় হয়ে উঠতে লাগল… হাঁটতে যেতাম ওদের নিয়ে, দু-দিক থেকে আমার হাত ধরে নিয়ে চলত—যেন আমাকে পথ দেখিয়ে আগাচ্ছে দুইজন… ভালোই লাগত আমার… কেউ না কেউ রাস্তায় বলতই ‘আপনার ব্যাটারা তো জোয়ান হয়ে উঠল, আপনার আর চিন্তা কী!’ বেশ মজাই লাগত এসব শুনতে… খুব মজা… ওদেরও মজা লাগত!
বাবা : আর আমাকে যখন কেউ বলত ‘যা দুইটা ছেলে তোমার; যেমন বুদ্ধিতে পাকা তেমনি পড়াশুনায়। আমি একটু কলার উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতাম ‘কার রক্ত দেখতে হবে না?’
[একটা ছোটো নীরবতা]
মা : অ্যান্থনি!
বাবা : কী?
মা : কীভাবে শুরু হলো এসব?
বাবা : আসলেই শুনতে চাও?
মা : চাই।
বাবা : আবার বলছি, কষ্ট হবে কিন্তু।
মা : আমিও আবার বলছি, সেসব আর কোনো ব্যাপার না আমার কাছে।
বাবা : গুসতাবুসের মৃত্যুর কারণ?
মা : [খুব দ্রুত] লালরা।
বাবা : খেওরখের মৃত্যুর?
মা : [দ্রুত] নীলরা।
বাবা : আর গুসতাবুস ও খেওরখে কারা ছিল?
মা : ওরা ওরাই ছিল—গুসতাবুস ও খেওরখে… [হঠাৎ থেমে] ওদেরই দোষ দিচ্ছ তুমি না? ওরাই মরল অথচ মরা ছেলে দুটোকেই দোষ দিচ্ছ?
বাবা : বলেছিলাম, তোমার ভালো লাগবে না শুনতে!
মা : মরেও শান্তি নেই, না! মরা ছেলেদেরই দোষ দিচ্ছ? তুমি ওদের দুষছ কারণ গুসতাবুস ছিল নীল আর খেওরখে ছিল লাল, তাই না? ঠিক আছে, একজন না হয় নীল ও একজন লাল; কিন্তু লাল-নীল-হলুদ হওয়া তো খারাপ না যতক্ষণ তুমি ভিতর থেকে খারাপ না হও। আামার ছেলেরা, শোনো ভালো করে, আমার ছেলেরা [‘আমার ছেলেরা’র ওপর জোর দিয়ে] ঐসব খুনি লাল-নীলের অংশ ছিল না—ওরা ছিল ভিতর থেকে ভালো মানুষ আর ভাতৃভাবাপন্ন। একজন আরেকজনকে ভালোবাসত… শুধু ওই টাইপরাইটারটা নিয়ে ফালতু খুনশুটি আর ঝগড়া লেগেই থাকত—দুই ভাইয়ে…
বাবা : এই তো, পথে এসো! আর কী করত তোমার ছেলেরা বলো?
মা : অবশ্যই বলব! তারা লিখত! লেখা কোনো খারাপ কাজ না। আর ওরা বেশ ভালোই লিখত—জানো তুমি। একটু আগে তুমিই গর্ব করে বলেছ ওরা কত মেধাবী ছিল। হ্যাঁ ছিল—সেই বুদ্ধি খরচ করেই লিখত ওরা, ধারালো সব লেখা।
বাবা : ওরা ভালো লিখত, জানি। লেখালিখি কোনো খারাপ কিছুও নয়। কিন্তু কী লিখত আমাদের ছেলেরা? অসত্য, মিথ্যা! রাজধানীর অপদার্থ পত্রিকাগুলোর জন্য নীল মিথ্যা আর লাল মিথ্যা। সেখানে মিথ্যাগুলো বোমার মতো ফাটানো হয়—ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ঢোল করা হয়! ভ্রাতৃত্ব বটে! ভাই-ই তো ছিল তারা; কিন্তু আমি জানতাম খারাপ কিছু একটা শুরু হচ্ছে যখন গুসতাবুস বলল সে নীল কাগজের জন্য লিখবে আর খেওরখে বলল সে লিখবে লাল কাগজে। জানতাম তখনই জঘন্য কিছু একটা দিয়ে শেষ হবে। ভাইয়েরা এভাবে আলাদা হলে সহিংসতাই তার একমাত্র যোগফল হতে পারে।
মা : বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না আমি!
বাবা : কে লিখেছে এটা? [দৃঢ় পদক্ষেপে সে মঞ্চের এক কোনার দিকে যায়—এই অংশটাতে এতক্ষণ অন্ধকার ছিল, এবার আলো জ্বলে হঠাৎ, বাকিটা ছায়ায় ঢেকে থাকে। অন্য স্পটগুলোতে এভাবে যখন নির্দেশ দেয়া হবে তখনই শুধু আলো জ্বলবে। আলোর নিচে একটা টেবিল ও চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা পুরনো, বলা যায়, বুড়ো টাইপরাইটার। মেঝেতে খবরের কাগজের মতো ভাঁজ করা নীল ও লাল কাগজের স্তূপ। ‘বাবা’ লাল স্তূপ ঘাঁটে। একটা কাগজ টেনে বের করে। এবার মঞ্চের কেন্দ্রের দিকে আগায়। প্রায় অন্ধকারে পড়া শুরু করে। এই সময় খেওরখে পিছন থেকে এসে চেয়ারে বসে টাইপরাইটারে লিখতে শুরু করে। খেওরখে পাপেট, সাদা পোশাক, লাল মুখোশ মুখে।] কে লিখছে এটা? শোনো : ‘স্থানীয় গির্জার পাদরি আজ তার বক্তৃতায় যিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন লালদের আর নীলদের উসকানি দিয়েছেন সশস্ত্রভাবে সংঘটিত হতে। যেকোনোভাবেই লালদের শেষ করে দিতে প্ররোচিত করেছেন তিনি। শুভবুদ্ধির ক্যাথোলিক যারা লাল দলে বিশ্বাস করেন তারা তৎক্ষণাৎ গির্জা থেকে বের হয়ে যান; কিন্তু গির্জা-প্রাঙ্গণে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা নীল গুন্ডাদের আক্রমণের শিকার হন। এরা সবাই পাদরি ও মেয়রের পোষা বাহিনী বলে জানা গেছে।’ [‘বাবার ওপর আলো পড়ে, টাইপরাইটার ও টেবিলের আলো নিভে যায়] কে লিখেছে, বলো?
মা : [আলোতে এসে] শুনে তো মনে হচ্ছে খেওরখের কোনো লেখা… পাদরিকে একটুখানি ভড়কে দিতে…
বাবা : একদম ঠিক বলেছ! হ্যাঁ খেওরখের লেখাই। কিন্তু ‘একটুখানি ভড়কে দিতে’ই সে যদি চাইত তবে মেরির গর্ভ-সঞ্চার নিয়ে অর্বাচীনের মতো যে অভব্য মন্তব্য পাদরি করেছিল, সেটা নিয়ে চালিয়ে গেলেই হতো। বক্তৃতার শেষ সাত-আট শব্দের ভিত্তিতে পুরোটার মু ঘুরিয়ে দেয়া… কোনো, তোমার ভাষায়, ‘একটুখানি ভড়কে দিতে’ চাওয়া নয়।
[মঞ্চের অন্যদিকে গির্জার প্রচার-মঞ্চ আলোকিত হয়। বেদির ওপর রাখা একটা টেইপ রেকর্ডার বেজে ওঠে। পাদরির কণ্ঠ শোনা যায়—প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর পরিষ্কার]
পাদরির কণ্ঠ : ভ্রাতা ও ভগিনীগণ, এভাবেই পাপীদের হাতে যিশু ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন—সমস্ত সময়ের সমস্ত পাপীদের হাতে; গতকাল ও আজকের পাপী, সর্বোপরি আজকের পাপীদের হাতে। যিশুকে তারা হত্যা করছে, প্রতিদিন। ক্যাথোলিকরা কোথায়—শুদ্ধ হৃদয়ের ও সাহসী মনের ক্যাথোলিকরা? যিশু যদি প্রতিদিন নিহত হন, সে শুধু আমাদের ভীরুতার জন্য। আমরা দুর্বলচিত্ত, যিশুকে রক্ষা করায় অসমর্থ। নিজেদেরই ধিক্কার দিতে হবে আমাদের অযোগ্যতার জন্য : স্বর্গ আমাদের জন্য নয়, সে শুধু সাহসীদের জন্য। স্বর্গের নীলাভ জগতে দুর্বলদের কোনো ঠাঁই নেই।
[প্রচার-মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আসে। এবার পাপেট লাল পত্রিকা বিক্রেতার ওপর আলো পড়ে। সে দর্শকদের মধ্যে—হাতে অনেকগুলো লাল পত্রিকা]
পাপেট লাল পত্রিকা
বিক্রেতা : গরম খবর! গরম খবর! গরম খবর! নীলেদের ওপর লালেদের জঘন্য নারকীয় হামলার লাল খবর! লাল দলের নীতি নির্ধারক কমিটি বিশপ বরাবর আঞ্চলিক পাদরির অকথ্য তাণ্ডবের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। খবর, তাজা, ভয়ংকর খবর। উপাসনা থেকে বের হওয়ার সময় শান্তিপূর্ণ লাল ক্যাথোলিকদের ওপর গুলি… গরম গরম খবর!
[পাপেট লাল পত্রিকা বিক্রেতা মঞ্চের ওপর যায় এসব বলতে বলতে। তারপর ওভাবেই বের হয়ে যায়। ‘বাবা’র ওপর আলো]
বাবা : [দর্শকদের দেখিয়ে] লোকজনদের দিকে তাকাও, দেখো—নীল, লাল সব এক। তারা বিস্মিত, হতবাক কারণ সবটা মিথ্যা, বানোয়াট। এর কিছুদিন পর সেইন্ট ইসিদরের উৎসব ছিল, মনে পড়ে? যথারীতি, অন্যবারের মতোই আমার বন্ধু ইসিদর তার নিরীহ আতশবাজি, হাওয়াই বাজি নিয়ে চার্চ প্রাঙ্গণে উপস্থিত…
[যেখানে চার্চের প্রচারণা-মঞ্চ ছিল, এখন সেখানে চার্চ-প্রাঙ্গণ। আলো পড়ে সেখানে। চাইলে একটি পর্দা ও তার ওপর দৃশ্যপট দেওয়া যেতে পারে। না হলে শুধু একটি কাল্পনিক প্রাঙ্গণ। পাপেট ইসিদর ও সাথে আরও কয়েকজন পাপেট সঙ্গী। তারা আতশবাজি নিয়ে ব্যস্ত—সেগুলো জায়গামতো বসানো, আগুন লাগানো ইত্যাদি। পুরো কাজ মূকাভিনয় হবে—এমনকি বাজি পোড়ানোর শব্দ। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ইসিদর বাজিগুলো উৎসর্গ করা শুরু করে]
পাপেট ইসিদর : এইটা আমার রক্ষক সেইন্ট ইসিদরের উদ্দেশে [একটা বাজিতে আগুন লাগায়] এইটা মা মেরির সম্মানে [আরেকটা পোড়ায়] এবারেরটা সেইন্ট জোসেফের সম্মানে [অন্য আরেকটায় আগুন দেয়] এই এটা পাদরির জন্য…
সঙ্গী পাপেট : ইসিদর, কী বোকার মতো কাজ করছ? তুমি তো বাজিগুলো চার্চের দিকে ছুড়ছ! যেকোনো একটা গিয়ে ভিতরে পড়তে পারে…
[আসলে বলতে বলতেই জোরে শব্দ শোনা যায়—একটা আকাশবাজি গিয়ে ফোটে চার্চের ভিতরে। উত্তেজনা, চিৎকার; ভীত পাপেট মানুষদের দৌড়াদৌড়ি। কিছুক্ষণ তুমুল বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোলের পর আলো পড়ে ‘বাবা’র ওপর। সে নীল পত্রিকার স্তূপ ঘাঁটছে। একটা পত্রিকা তুলে নিয়ে আগের মতো মধ্য-মঞ্চে যায়, সেখানে আলো কম, গুসতাবুস আলোতে আসে অর্থাৎ টেবিল-চেয়ারকেন্দ্রিক যে আলো সেখানে। টাইপরাইটারে লিখতে শুরু করে। গুসতাবুস—অবশ্যই পাপেট—আর আগের খেওরখে একই ‘ব্যক্তি’, শুধু নীল মুখোশ পরা]
বাবা : [অন্ধকারে। গুসতাবুস লিখে চলে] এই ঘটার ওপর গুসতাবুস লিখেছিল—‘গত রোববার চার্চের জমায়েতে লালদের বর্বরতম হামলা-গুলি ও বোমা ছুড়ে মারে তারা পাদরিসহ অন্যান্য ক্যাথোরিকদের ওপর। ভাগ্যক্রমে, নীলরা যথেষ্ট প্রস্তুত ছিল। তারাও পালটা জবাব দেয় এই লাল সন্ত্রাসের। আহত হন বহু লোক, কয়েকজনের অবস্থা বেশ আশংকাজনক। এই নিষ্ঠুর আক্রমণে যারা আহত হন তাদের শুশ্রুষার জন্য শহর থেকে ডাক্তার আনতে হয় কারণ স্থানীয় লাল ডাক্তার এদের চিকিৎসা করতে রাজি হননি।
পাপেট নীল পত্রিকা
বিক্রেতা : [তার ওপর আলো, দর্শকদের মধ্যে] গরম খবর! তাজা খবর! চার্চে হামলা-নীলদের ওপর আক্রমণের খবর! পড়ুন লাল পত্রিকা! পাদরির ওপর গুলি, ক্যাথোলিকদের ওপর বোমা, ডাক্তারের জঘন্য আচরণ। খবর! গরম, খাস খবর! পঁচিশজন নীলের মৃত্যু! পিতাহারা সন্তান ও স্বামীহারা নারীদের আর্তনাদ—বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। [মঞ্চের দিকে বলতে বলতে যায় এবং বের হয়]
মা : [দুইজন মঞ্চের মাঝখানে। সেখানে আলো] গুসতাবুস খালি একটু মজা করতে চেয়েছিল। খেওরখের সাথে ওর এই শিশুতোষ খুনশুটি তো লেগেই থাকত। আর ডাক্তারের ব্যাপারটা—তুমি তো জানো, ডাক্তার তার মেয়ের সাথে গুসতাবুসকে দেখা করতে মানা করায়…
বাবা : মজা! মজা করার আর উপায় খুঁজে পেল না? খেওরখের জামার পকেটে মরা তেলাপোকা রেখে দিতে পারত, মাথার পেছনের চুল ছেঁচে দিতে পারত ঘুমানোর সময়… আর মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরলে তো… যাই হোক… দেখো, ওই মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখো—[দর্শকদের দিকে দেখিয়ে] ওদের মুখে আর বিস্ময় নেই, ভয় তিক্ততা আর ঘৃণা এখন! ঘৃণা! তারপর থেকে পত্রিকার খবরে, সম্পাদকীয়তে আর লাগাম রইল না, যে যতটা পারল ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সত্যের এতটুকু বালাই না রেখে ছাপাতে লাগল সব… একটা ছোটো ম্যাচের কাঠি দিয়ে কত বড় দাবানল লাগানো যায় কে জানে!
পাপেট নীল পত্রিকা
বিক্রেতা : [আবার দর্শকসারি থেকে] খবর! তাজা! জ্যান্ত খবর! নীল পত্রিকায়…
পাপেট লাল পত্রিকা
বিক্রেতা : [সেও দর্শক সারিতে] গরম, খবর! সত্যি খবর! লাল পত্রিকায়…
পাপেট নীল পত্রিকা
বিক্রেতা : [এবার মঞ্চের একটু কাছে] খবর খবর, হালাল খবর! নীল কাগজ…
পাপেট লাল পত্রিকা
বিক্রেতা : [সেও মঞ্চের কাছে] দেশি খবর, খাঁটি খবর… লাল পত্রিকা…
পাপেট নীল পত্রিকা
বিক্রেতা : [মঞ্চে] নিন, নিন পড়ুন… সত্যের পথে আসলেই আপসহীন… নীল পত্রিকা… নিন-নিন… [বের হয়ে যায়]
পাপেট লাল পত্রিকা
বিক্রেতা : [মঞ্চে] সত্যের খোঁজে নিরন্তর অবিচল… লাল খবরের কাগজ… নিন… নিন… [বের হয়ে যায়]
[পাপেট পত্রিকা বিক্রেতারা বের হতে হতে মঞ্চে ঢোকে গুসতাবুস ও খেওরখে। আলো পড়ে টেবিল ও টাইপরাইটার ঘিরে। গুসতাবুস এবং খেওরখে যেহেতু একই অভিনেতা তাই মুখোশ বদলে বদলে এখানে চরিত্র বদলাবে। পাপেট নীল পত্রিকা বিক্রেতা যখন চিৎকার করবে তখন নীল মুখোশ আর লাল পত্রিকা বিক্রেতার সময় লাল মুখোশ। মুখোশ কিন্তু দর্শকের সামনেই বদলানো হবে—যে মুখোশটা ব্যবহৃত হবে না সেটা থাকবে টাইপরাইটারের পাশে। পত্রিকা বিক্রেতারা পুরো বের হলে টেবিলের স্পট লাইট নিভে আসবে]
বাবা : [‘বাবা-মা’ মঞ্চের মাঝখানে—আলোয়] বাকিটা এই যে! [নীল-লাল কাগজের স্তূপের দিকে নির্দেশ করে, আলো পড়ে কাগজের ওপর] আর ওখানে… [কফিনদুটোর দিকে দেখায়] আর ওখানে… সেখানে… ঐ দিকে… [মঞ্চের বিভিন্ন দিকে দেখায়]… যেখানেই একটা বিধ্বস্ত বাড়ি, ভস্মীভূত ফসলের মাঠ… রাস্তার তে-মাথায় গাছের সাথে ঝোলানো মড়া… এখন তাদের প্রিয় রং দুটোর জন্য তারা মানুষ খুন শুরু করে—তাদের আদরের নীল, আদরের লাল। কিন্তু এ তো কেবল শুরু। এরপর তারা খুন করবে শুধু খুনের জন্যই, খুন করার আনন্দে। এজন্যই আমি বলেছিলাম কী করে শুরু হলো এসব সেটা জেনে কী হবে! জানা দরকার কীভাবে এসব শেষ হবে, কখন শেষ হবে!
মা : কিন্তু আমায় বলো যারা মরল তারা কীভাবে দায়ী হয়?
বাবা : নদী কখনো তার উৎসে ফেরে না… বলেছি তোমায়।
মা : ওরা আমার ছেলেদের আমার শরীরের ওপর মেরে ফেলে গেল। নীল খুনিরা আমার খেওরখেকে খুন করল আর লাল খুনিরা মারল আমার গুসতাবুসকে! মরুক ওরা সব!… একটা করে বন্দুক দিয়ে গুলি করে ফেলে রেখে গেল আমার ছেলেদের, দাঁড়াও…[বের হয়ে যায়]।
বাবা : যাচ্ছো কোথায়?
মা : এক্ষুনি আসছি। [একটা বন্দুক নিয়ে ফিরে আসে] এটা আমরা ফেলে দেবো—এখনই। পুড়িয়ে ফেলব, ধ্বংস করে ফেলব—দোষ যদি কাউকে দিতে হয় তবে এই এটাকে দাও… আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটল… এই দেশে যা হচ্ছে সবকিছুর জন্য…
[বন্দুকটা ছুড়ে দেয়, ‘বাবা’ সেটা ধরে ফেলে—দেখা যায় এটি একটি ২২ ক্যালিবারের রেমিংটন]
বাবা : তুমি আসলেই মনে করো এটা দায়ী?
মা : কেন, ওরা বন্দুকের গুলিতে মরেনি? [কফিনের দিকে দেখিয়ে] তুমি বললে না, এ কেবল শুরু এবং আরও মরবে এই বন্দুকের গুলিতে? বলোনি? তোমার হাতে কি সেই বন্দুক না?
বাবা : হ্যাঁ, ২২ ক্যালিবারের একটি রেমিংটন রাইফেল।
মা : তাহলে কী! শেষ করে দাও ওটা—যদি তুমি না চাও ওটাই আমাদের শেষ করে দিক!
বাবা : এই নিরীহ বস্তুটা—যে চোর গুন্ডা বদমাশ কখনো আসে না তাকে গুলি করার জন্য অপেক্ষা করে। আমি বলছি না বন্দুকগুলো দিয়ে সহিংস কিছু হচ্ছে না। হ্যাঁ, মানুষ মরছে—বন্দুকের গুলিতেই মরছে। লাল বন্দুকের গুলিতে নীল মানুষ আর নীল বন্দুকের গুলিতে লাল মানুষ মরছে; আরও মরবে, তখনও এই ভিন্ন রঙের বন্দুকের গুলিতে। কিন্তু… মানুষের হাতে বন্দুক—গুলি তুলে দিলো কারা? [খবরের কাগজে চাপড় দিয়ে] আরও পড়ব—এখান থেকে? বন্দুকের চেয়েও বিপজ্জনক, ভয়ানক কিছু একটা চিনি আমি।
মা : বন্দুকের চেয়ে বিপজ্জনক? যে খুনিরা আমার ছেলেদের মেরেছে তাদের হাতে হাতে আর বেশি বিপজ্জনক কী থাকতে পারে?
বাবা : এই দেখো! [বন্দুকটা টেবিলের ওপর ছুড়ে মারে, টাইপরাইটারটা তুলে নেয়] এই যে! আমাদের মূর্খ দুই ছেলের হাতের বিপজ্জনক খেলনা।
মা : না! না! [কাছে গিয়ে আলতো করে স্পর্শ করে] কী করে বললে তুমি এটা, ওদের প্রিয় টাইপরাইটার নিয়ে!
বাবা : এটা একটা রেমিংটন।
মা : রেমিংটন?
বাবা : ১৯২২-এর মডেল।
মা : ওহ্! রেমিংটন বাইশ! [ভয়ানক যন্ত্রণা নিয়ে কফিনদুটোর দিকে তাকায়।]
পর্দা
দ্বিতীয় তরঙ্গ
দৃশ্যপট
দুই রঙের রাস্তা—দর্শকদের ডানে নীল, বামে লাল। রাস্তার পাশে বাড়ি বোঝানোর জন্য কাঠের লাল-নীল প্যানেলের ওপর সাদা-কালো বড়-বড় ব্রাশের আঁচড়। কোনো ডিটেইলিং নেই।
পর্দা উঠলে আমরা লাল-নীল পাপেট প্রতিবেশীদের দেখব বন্দুক কাঁধে গুসতাবুস ও খেওরখের কফিন ঘিরে দাঁড়িয়েছে। পাপেট নীল পুরুষ প্রতিবেশীরা নীল পতাকাওয়ালা কফিন কাঁধে নেবে। পাপেট লাল পুরুষ প্রতিবেশীরা লাল পতাকাওয়ালা কফিন কাঁধে নেবে। মঞ্চের কেন্দ্রে ‘বাবা-মা’ অস্ত্রহীন বলাবাহুল্য। মিউজিক শুরু হলে সমাধিক্ষেত্রের দিকে শবযাত্রা শুরু হবে। ধীরে ধীরে মঞ্চের পেছনের অংশ দিয়ে বের হতে হতে মঞ্চ কিছুক্ষণের জন্য পুরো অন্ধকার থাকবে। শুধু প্রতিবেশীরা ফিরবে। মঞ্চে ঢোকার মুখে দুই পক্ষই থামবে কারণ এই সময় পিছন থেকে পাপেট নীল পত্রিকা বিক্রেতা ও পাপেট লাল পত্রিকাওয়ালা ঢুকবে। উত্তেজিত।
পাপেট নীল পত্রিকা
বিক্রেতা : খবর, এক্সট্রা খবর! তাজা খবর!
পাপেট নীল পত্রিকা
বিক্রেতা : খবর, এক্সট্রা খবর! গরম খবর!
পাপেট নীল পত্রিকা
বিক্রেতা : লালদের হাতে নীল পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা খুন!
পাপেট লাল পত্রিকা
বিক্রেতা : নীলদের হাতে লাল পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা খুন!
কড়ই গরমই ছিল—এই তেলটুকু পড়তে ছিল বাকি। নীল এবং লালরা যে যার পক্ষের পত্রিকা কেনে। পত্রিকা বিক্রেতারা বের হতে হতে সবাই পত্রিকা পড়ে। তেতে ওঠে তারা। একদল আরেক দলকে হুমকি দিতে থাকে। পুরো ঘটনাটা হবে মূকাভিনয়ে। তারপর আক্রমণ। রাস্তার মাঝখানেই পুরো যুদ্ধটা। অন্ধকার, চিৎকার, গুলির মুহুর্মুহু আওয়াজ। তারপর পিনপতন নীরবতা। একটা হালকা আলো পড়বে গাদা গাদা মৃতদেহের ওপর—ছড়ানো ছিটানো আগ্নেয়াস্ত্র এবং লাল-নীল পত্রিকা। পত্রিকা বিক্রেতারা পিছন দিক হতে মঞ্চে ঢোকে—চিৎকার করে না, ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নেয়, মৃতদেহগুলো লক্ষই করে না। অন্ধকার হয়ে আসে, বাতাস এসে উড়িয়ে নাড়িয়ে দেয় পত্রিকাগুলো—তার কিছু কিছু মৃতদেহের ওপরও পড়ে। দূরের চার্চ থেকে বারোটা বাজার ঘণ্টা এরপর ভক্তিসংগীত শুরু হয়।
পর্দা
তৃতীয় তরঙ্গ
[শূন্য মঞ্চ। অন্ধকার। বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠস্বর ও শব্দ মঞ্চের ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে আসবে]
প্রধান গুন্ডার কণ্ঠ : অ্যাই! তুই কে?
ভীত মানুষের কণ্ঠ : আমি… আমি… সম্ভবত নীল
প্রধান গুন্ডার কণ্ঠ : তোরা শোন! বলছে ও নীল!
[কাছ থেকে গুলির আওয়াজ। ধপ করে শরীর পড়ার শব্দ]
প্রধান গুন্ডার কণ্ঠ : আর তুই…? তুই কে?
আশাবাদী কণ্ঠ : লার, লাল। আমি লাল।
প্রধান গুন্ডার কণ্ঠ : এইটা বলছে লাল—শুনলি তোরা?
[গুলি এবং ধপ করে শরীর পড়ার শব্দ]
প্রধান গুন্ডার কণ্ঠ : এবার দেখি… তুই? তুই কোন চ্যাটের বাল?
আশাহীনের কণ্ঠ : কিছু না, কিছু না… মুই এইসব কিছু না, কৃষিকাজ করি… মুই কিছু জানি না…
প্রধান গুন্ডার কণ্ঠ : হ্যাঁ!… তুমি চাঁদু নিজের ইয়ে বাঁচাতে চাও! [প্রধান গুন্ডাসহ সবাই হো হো করে হাসে] কৃষক, ‘মূর্খ কৃষক’, না? আর বাকিরা সবাই শিক্ষিত, জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী! [আরও হাসি] যাই হোক, তোর জন্য ভালোই হলো—অন্তত প্যান্ট পরা অবস্থায় মরবি, তোর শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা জাঙ্গিয়া পরে ঘুমায় বুঝলি, কৃষকরা প্যান্ট-ট্যান্ট পরে বিছানায় যায়। তাই তাদের ওভাবেই গুলি করতে হয়—কাউকে তো আর ন্যাংটো করে গুলি করা যায় না বল? দেখো বাবা, ব্যাপারটা হলো, তোমার নোংরা প্যান্টের নিচে তুমি যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক বুদ্ধিজীবী টকশোজীবী হও সেটা কিন্তু তোমাকে বাঁচাবে না। কত কত ভদ্দরনোকেদের বাসায় গেলাম—জাঙ্গিয়া পরা প্রাণীদের খাটের নিচ থেকে টেনে বের করতে হয়েছে। সে এক দৃশ্য! [হাসে] আরও মজা হলো ওসব বাড়িতে বিনা বাধায় বাড়ির মেয়ে-বউদের নিয়ে একটু আনন্দ-ফুর্তি ইত্যাদি করা যায়, বুঝলি? তার মধ্যে আবার তাদের টিশকাও করতেও মজা : হাঁটু মুড়ে জোড়হাত করে ক্ষমা-টমা চেয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে বাবুরা-একটুও, যাকে বলে, ‘ফাইট-ব্যাক’ করার চেষ্টা করবে, না। ওদের লাইসেন্স করা পিস্তল কিন্তু বালিশের নিচেই ঘুমায়। উ-উ-উ ক্ষমা-ক্ষমা-ক্ষমা-তুমিও তাই পণ্ডিত চাষা! অবশ্য তুমি তার চেয়ে খানিকটা চালাক আর অতি চালাকের বুকে গুল্লি! [হাসি] অবশ্য চালাক আর না-চালাক, ভালো করে মরতে পারলেই হয়… দেখবে বেশি চালাক?… এই তো, কাঁদে না সোনা… আপ গোলি খা কালিয়া [ব্যাং]।
অর্থাৎ, তৃতীয় গুলির শব্দ, তৃতীয় শরীরের পতন। অস্ত্রের ঝনঝনানি করে চলে যায় সশস্ত্র লোকজন। তারপর দুঃসহ নীরবতার মধ্যেই ধীরে ধীরে আলো জ্বলতে শুরু করে মঞ্চে। পিছন অংশে পুরোটা জুড়ে একটা সাদা নগ্ন পর্দা এমনভাবে রাখা এবং আলো এমনভাবে প্রজেক্ট করা হয় যেন মঞ্চে যা হচ্ছে তার ছায়া ছোটোবড় এমনই বিকৃতভাবে পর্দায় খেলা করে। এই পর্দার পেছনে আরেকটা পর্দায় গ্রামীণ বিষণ্ন রাতের দৃশ্য—কালো কালিতে আঁকা।
দর্শকদের বামপাশে বোঝা যায় আগে একটা কৃষি খামার ছিল—এখন আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। ডানে দেখব গ্রিনগো—কে-দর্শকদের দিকে পিঠ দিয়ে রেমিংটন মডেলের একটা টাইপরাইটার লিখছে। তার লেখার ডেস্কটা কোনো নড়বড়ে বক্স দিয়ে তৈরি অথবা একগাদা ইটের ওপর একটি কাঠের বোর্ড দিয়েও হতে পারে। গ্রিনগো বিদেশি পত্রিকার সংবাদদাতা। যে যে পত্রিকায় সংবাদ পাঠায় সেগুলোর নাম খুঁটিতে খুঁটিতে সারিবদ্ধভাবে সাজানো—সংখ্যায় অনেক—মনে হবে কোনো ক্রসরোডের ট্রাফিক লাইট।
মঞ্চের কেন্দ্রে তিনজন মৃত কৃষকের শরীর। তিনটি সত্যিকারের পাপেট। শরীরে খড়কুটোর ডগা এখান-ওখান দিয়ে বের হয়ে আছে—বিশেষ করে হাত-পায়ের শেষ অংশগুলো ছ্যারাব্যারা করে রাখা। মাথাটা নারকেলের—চুন দিয়ে চোখমুখ নাক ফোটানো হয়েছে। তিনটি পরিত্যক্ত কাকতাড়ুয়ার মতো দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে ওগুলো। শরীর তিনটির বিশাল ও বিকৃত ছায়া পড়ছে পেছনের পর্দায়।
গ্রিনগো লিখছে একাগ্রভাবে—কোনো দিকে না তাকিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে যে ঘটনা ঘটেছে তার রিপোর্ট লিখছে। রেমিংটন টাইপরাইটারের ক্লিক ক্লিক শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।
পাপেট কালো পোশাকের দেবদূত ঢুকল। অর্থাৎ, সে দেবদূত কিন্তু পাপেট। মনে রাখতে হবে ‘বাবা’, ‘মা’ ও গ্রিনগো ছাড়া সবাই পাপেট এবং সেভাবেই তারা নড়বে চড়বে কথা বলবে। অবশ্যই পাখা আছে দেবদূতের। যেদিকেই তাকাচ্ছে, যা দেখছে অর্থাৎ মেঝের পড়ে থাকা পাপেট, গ্রিনগো, দর্শক—সব দেখেই সে বিস্মিত হচ্ছে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। পড়ে থাকা পাপেটগুলোর দিকে আগায়; হাত-পাগুলো ধরে ওঠায়, ছেড়ে দেয়, পড়ে যায়—প্রাণহীন। গ্রিনগোর দিকে তাকায়, হাত বাড়ায় এবং একই হাত দিয়ে পাপেটগুলো দেখাতে চেষ্টা করে
পাপেট কালো পোশাকের
দেবদূত : [পাপেট-কণ্ঠে কিন্তু দেবদূতীয় ঢঙে—মৃদু, কোমল] গ্রিনগো… গ্রিনগো… [গ্রিনগোর কোনোকিছুর দিকে মনোযোগ নেই, লিখে চলে। পাপেট কালো পোশাকের দেবদূত আবার ডাকে—এবার একটু জোরে] গ্রিনগো… এই গ্রিনগো! [গ্রিনগো এবারও লক্ষ করে না, শরীরের সমস্ত শক্তি, মনোযোগ দিয়ে টাইপ চালিয়ে যায়। তৃতীয়বারের মতো পাপেটগুলো নির্দেশ করে দেবদূত তাকে ডাকে—আরও জোরে] গ্রিনগো!! গ্রিনগো!!
গ্রিনগো : [না ঘুরেই] আচ্ছা বাবা, আচ্ছা…
গ্রিনগো তার বাঁ হাত প্রসারিত করে এমনভাবে নাড়ায় সে শুনতে পেয়েছে। কিন্তু সে আবার লেখা শুরু করে। পাপেট কালো পোশাকের দেবদূত এক ধরনের মর্যাদা বজায় রেখে অথচ স্বভাবসুলভ দেবদূতীয় কায়দায় নিচু হয়ে মৃতদেহগুলো (অর্থাৎ, পড়ে থাকা পাপেট তিনটি) তুলে নেয়—ডান হাতে দুটো, বাম হাতে একটা। এভাবে বের হয়ে যায়। আলো মিইয়ে যেতে থাকে। গ্রিনগো রেমিংটন মেশিনের সামনে বসে খটাংখটাং করে লিখে চলে—দর্শকদের দিকে পিঠ দিয়ে। পুরো অন্ধকার হলে হঠাৎ এক নারীর চিৎকার শোনা যায় দর্শকদের পিছন থেকে—বাঁচাও! বাঁচাও! দর্শকসারির মধ্যদিয়ে সন্ত্রস্ত দৌড়ে আসে পাপেট কিষানি-পাপেট গুন্ডারা তাড়া করছে তাকে। মঞ্চের কাছাকাছি এলে মঞ্চে আলো জ্বলে।
আগের মতোই—পুড়ে যাওয়া খামার, ধোঁয়া উড়ছে, গ্রিনগো টাইপ করছে। মেঝেতে পড়ে থাকা কৃষকদের মৃতদেহ-পাপেট মৃতদেহ, একইভাবে ফেলে রাখা। পাপেট কিষানিকে তাড়া করছে পাপেট গুন্ডারা…মঞ্চজুড়ে দৌড়াদৌড়ি দাপাদাপি; কিষানির চিৎকার ‘বাঁচাও, বাঁচাও’; মৃতদেহগুলোর ওপর দিয়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে, এদিক-ওদিক-সেদিক—সবদিক। কখনো-কখনো গুন্ডারা মহিলাকে প্রায় ধরে ফেলে, স্কার্টে হাত পড়ে, টেনে ধরতে চেষ্টা করে, কোনো রকমে ছুটে যায়—এভাবে চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সাদা পর্দার পেছনে চলে গেলে তখন বুঝতে পারি কিষানি ধরা পড়েছে, পর্দায় ছায়া থেকে বুঝতে পারি তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া ধাক্কাধাক্কি চলছে—কে আগে—কে আগে সেই খেলা—শেষবারের মতো তীক্ষ্ন অথচ হাল-ছেড়ে-দেয়া চিৎকার—বাঁ-চা-ও! আলো নিভতে থাকে—গ্রিনগো তখনও লিখছে।
একটু পর, আলো আসে যখন, পাপেট, সাদা পোশাকের দেবদূতকে দেখি সেখানে বসে থাকতে যেখানে পাপেট কিষানিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পাপেট সাদা দেবদূত পরিপূর্ণ সাদা পোশাকে—পাপেট কালো দেবদূত যেমন ছিল কালোতে। তার দুই বাহু প্রসারিত, দুই হাতে কিছু একটা ধরে রাখা। এবার সে দাঁড়ায়, এখন বোঝা যায় তার হাতে একটা পাপেট শিশু—খড়, ন্যাকড়া দিয়ে তৈরি সত্যি পাপেট। মৃত শিশুটাকে দেখায় গ্রিনগোকে—‘আচ্ছা বাবা! আচ্ছা!’ বলে আবার লেখায় মনোযোগ দেয় সে, দর্শকদের দিকে পিঠ। পাপেট সাদা পোশাকের দেবদূতকে বিহ্বল ও বিচলিত হয়ে উঠতে দেখি, এভাবেই চলে যেতে শুরু করে মেঝেতে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো দেখে বিহ্বলতা বেড়ে যায়। কী করবে বুঝতে পারে না যেন। শেষ পর্যন্ত দেবদূতীয় মর্যাদা ও গাম্ভীর্য ভেঙে পড়ে তার, কোনোমতে তাড়াহুড়ো করে সবকটা দেহ তুলে নিয়ে বের হয়ে যায়। হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার।
একটু পরই আলো এলে মঞ্চে দেখি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা—গভর্নর দপ্তর, মেয়রের অফিস, ন্যায়বিচার দপ্তর ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর। একটি করে কাঠের দরজার কাঠামো এর সাথে নির্দিষ্ট দপ্তরের নাম দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো হবে। পিছনের দৃশ্যপটে এখনও বড় সাদা পর্দা। এমনভাবে আলো পড়বে যেন পর্দার পেছনে যা ঘটবে তার ছায়া পড়বে পর্দায়—ছায়ার ভিতর দিয়ে বিভিন্ন উঁচু ভবনের বিমূর্ত রূপ—যা বোঝানোর জন্য সাদা পর্দার পেছনেও আরেকটি পর্দায় কালো কালিতে এসব স্কেচ দেখানো যেতে পারে। গ্রিনগো মঞ্চের মাঝ বরাবর কিন্তু প্রান্তসীমায় চেয়ারে বসা—দর্শকদের দিকে পিঠ দিয়ে, এখনও লিখছে টাইপরাইটারে।
পাপের কৃষক দল, সকল বয়সের লিঙ্গপরিচয়ের, ঢোকে। তাদের হাতে, মাথায় বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র—প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে খুব তুচ্ছ কিছুও আছে; দেখেই মনে হবে দ্রুত পালানোর সময় হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়েই ছুটেছে। এভাবে যেন এক তীর্থযাত্রা শুরু হয়, এক দুঃখজনক সন্ধান—এক দরজা থেকে অন্য দরজা, এক অফিস থেকে অন্য অফিস।
প্রথমে গভর্নরের অফিস। দরজায় নক করার অভিনয়। পাপেট সরকারি কর্মচারী বেরিয়ে আসে। তার সাথে পাপেট কৃষকদের সাথে একটা সংলাপ চলে—শব্দ দিয়ে নয়, অঙ্গভঙ্গি করে কথা হবে। এটা স্পষ্ট হবে কৃষকরা নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত এবং তারা ন্যায়বিচার চায়, সাহায্য চায়। তারা গভর্নরের সাথে কথা বলতে চায় কারণ তাদের মনে হয় গভর্নর তাদের সাহায্য করবে। পাপেট সরকারি কর্মচারী তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে যে গভর্নর খুব দুঃখ পেয়েছেন তাদের ভিটাছাড়া হওয়ার ঘটনায়, এবং এটা একটা ট্র্যাজেডি। তিনি তাদের সাহায্য করতে চান এবং করবেনও সময়মতো তবে এই মুহূর্তে তিনি দেখা করতে পারছেন না, তিনি খুবই ব্যস্ত। তবে তিনি তাদের মেয়রের সাথে দেখা করতে বলেছেন। পাপেট কৃষক দল বোঝে এখানে কিছু হবে না—মেয়রের অফিসে যেতে হবে। তারা যাওয়ার জন্য পথ বদলাতে শুরু করে। সেই সময় পাপেট আলোকচিত্রী ব্যস্তভাবে আসে। আগের জায়গায় যেতে বলে, ছবি তুলবে—পোজ—ক্লিক—ফ্ল্যাশ! এবার মেয়রের অফিস। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি : সংলাপ, ছবি তোলা, ন্যায়বিচার দপ্তরে যেতে বলা কারণ মাননীয় মেয়র প্রচণ্ড ব্যস্ত। এই অফিসের সরকারি কর্মচারী ও আলোকচিত্রী গভর্নরের অফিসের একই ব্যক্তিদ্বয়। তারা দর্শকদের সামনেই এক অফিসের দরজা থেকে অন্য অফিসের দরজায় গিয়ে রোল প্লে করে। ন্যায়বিচার দপ্তরেও একই ঘটনা; এখান থেকে পুনর্বাসন দপ্তরে, সেখানেও একই নাটক। সেখান থেকে আবার গভর্নরের দপ্তরের সামনে।
একজন পাপেট কৃষক হঠাৎ যেন বুঝতে পেরে বেঁকে বসে—এই খেলা আর তারা খেলবে না। মূকাভিনয়ে সে বোঝায় এখানে তারা এসেছে আগে, আর তারা পুনরাবৃত্তি চায় না, প্রতারণা চায় না। হাল ছেড়ে দেওয়া, ক্লান্ত, পরাজিত মানুষদের মতো শুয়ে পড়তে থাকে তারা—একজনের ওপর আরেকজন, এভাবে এক স্তূপ মানুষে পরিণত হয় তারা। এই সময় পাপেট সরকারি কর্মচারী আর আলোকচিত্রী দরজাগুলোর ওপরের প্ল্যাকার্ডগুলো খুলে ফেলে।
রাত বাড়ে, রাতের ঘনায়মান অন্ধকার সাদা পর্দায় পড়া একগাদা কৃষকের শরীরের ছায়াকে, তাদের জীবনের দুঃখকে আরও দীর্ঘ ও বেদনাবহ করে তোলে। তখন এক নতুন কৌতুক শুরু হয়—পর্দার ওপার থেকে তিনজন সাইকেল আরোহী প্রচণ্ড বেগে যাতায়াত করে। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত অবস্থা। তাদের পেছনে হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে দৌড়ায়, হাঁসফাঁস করে ধারাভাষ্যকার। অবশ্যই মূকাভিনয় পুরোটা, যেন এক ব্যালে নাচ হচ্ছে। এদের পেছনে—যেন বিচ্ছিন্ন, পেছনে পড়া, পরাজিত সাইক্লিস্টের মতো ঢোকে পাপেট সাদা-কালো পোশাকের দেবদূত। কোমরের ওপর অংশ সাদা জার্সি এবং নিচে কালো খেলার প্যান্ট পরা—রোমশ পা দেখা যাচ্ছে। এরপর ঢোকে পাপেট রানিরা।
পাপেট রানিদের—নব তরঙ্গের রানি, হরতালবিহীন এক সপ্তাহের রানি, চোরাচালানমুক্ত পর্যটনের রানি, উননব্বই কর্মদিবস অনুপস্থিত সংসদ সদস্যদের রানি, জেল পালানো কয়েদিদের রানি, বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তাদের রানি, জাতীয় দেউলিয়া রেইল সংস্থার রানি, ঠান্ডা বিশ্বশান্তির রানি—একে-একে নাম ঘোষণা করা হয়। নবতরঙ্গের রানি হচ্ছে তথাকথিত হালফ্যাশনের ‘বাদ’গুলোর একটা জোড়াতালি মারা জগাখিচুড়ি টাইপ। উননব্বই কর্মদিবস অনুপস্থিত সংসদ সদস্যদের রানির নাম ঘোষণা করা হয়; কিন্তু যথারীতি তিনি অনুপস্থিত। ঠান্ডা বিশ্বশান্তির রানি যা কিছু এতক্ষণ মঞ্চে হলো তার প্রতি একটি সপাট চপেটাঘাত—তাকে দেখে মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করছে।
এভাবে নির্দেশক তার চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনশক্তি ও কল্পনা দিয়ে একেকজন রানির রাজত্বের ক্যারিকেচার প্রকাশ করবেন—সেই সাথে আমাদের ভক্তি-গদগদ আনুগত্যপ্রবণ সমাজকাঠামোর ক্যারিকেচারও। সাতজন রানির চরিত্রই, যথার্থ নির্দেশনায়, একজন শক্তিশালী অভিনেতা করতে পালে ভালো—মুহূর্তে-মুহূর্তে বদলে যাবে তার শারীরিক ভাবভঙ্গি এবং সেই সাথে প্রয়োজনীয় মানসিক রূপও। অন্যথায় সাতজন অভিনেতাও সাত চরিত্র করতে পারে। কাঠের ফ্রেইমগুলোই, যেগুলো একটু আগে দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, রানিদের উপস্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হবে। মঞ্চ অন্ধকার, এক-এক ফ্রেইম আলোকিত হবে এবং এক-এক রানি এসে তার রোল-প্লে করবে। একবার এক ফ্রেইম, আরেকবার আরেক ফ্রেইম। আলো, অন্ধকার এবং রানিদের আত্মপ্রদর্শনের খেলা—দ্রুত এবং প্রাণপূর্ণ। লাফ দিয়ে অন্ধকার থেকে আলোকিত দরজায় আসবে নির্দিষ্ট রানি, দর্শককে অভিবাদ জানাবেন, তার চরিত্রানুযায়ী মূকাভিনয় করবে, আবার লাফ দিয়ে বের হয়ে যাবে অন্য আলোকিত দরজায়। দর্শকদের সাথে রানিদের পরিচয় করিয়ে দেবে পাপেট পুরো পোশাকের দেবদূত। এক আলোকিত দরজায় এক রানি এসে পড়লে দেবদূতও সেই আলোতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরিচয় করিয়ে সরে যাবে।]
পাপেট পুরো পোশাকের
দেবদূত : [মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে] ভদ্রমহিলা এবং ভদ্র মহোদয়গণ… নবতরঙ্গের… রানি…! [এভাবে এক ফ্রেইম থেকে আরেক ফ্রেইমে গিয়ে রানিদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। শুধু উননব্বই কর্মদিবস অনুপস্থিত সংসদ সদস্যদের রানি অনুপস্থিত। তার ক্ষেত্রে ঘোষণার বেশ কিছুক্ষণ পর সে টের পাবে কেউ নেই ফ্রেইমে] সুধী উপস্থিতমণ্ডলী এবার আসছেন উননব্বই… কর্মদিবস অনুপস্থিত… সংসদ সদস্যদের রানি…! [বিব্রত হয়ে কিছু অঙ্গভঙ্গি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করবে] প্রিয় উপস্থিত শোতৃমণ্ডলী… ইয়ে… হলো গিয়ে উননব্বই কর্মদিবস… অনুপস্থিত সাংসদদের রানি… তিনি আসলে শীতকালীন সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়েছেন…
এতক্ষণ পর্যন্ত মোটামুটি সব স্বাভাবিকই ছিল। আলো-অন্ধকার-রানি এবং দেবদূতের খেলাটা দ্রুতগতিতে কিন্তু সরলভাবেই ঘটছিল। এবার লয় বাড়তে থাকবে—সেই সাথে রানিদের নতুন নতুন পরিচিতি বলা শুরু হবে—প্রশস্তিমূলক ভাষায়। একসময় গতি এত বেড়ে যাবে যে একটা চোখ ঝলসানো আলোর নৃত্যের সাথে অলৌকিক ও দুঃস্বপ্নের একটা আবহ তৈরি হবে—একবার এ ফ্রেইম আলোকিত হবে তো হুট করে নিভে অন্য একটা জ্বলবে, আবার অন্য একটা। এত দ্রুত সব বদলাবে অর্থাৎ পুরো পোশাকের দেবদূত সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। আলো-অন্ধকারের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারবে না সে—হঠাৎ থেমে যাবে কোথাও, পিছলে পড়বে, উল্টে যাবে, মুখ থুবড়ে পড়বে ইত্যাদি সব। চিৎকার করে রানিদের নাম বলা শুরু করবে পাগলের মতো। শেষ পর্যন্ত সে রানিদের নামও গুলিয়ে ফেলবে অনেকটা এভাবে—চোরাচালানকারী সাংসদদের রানি, পর্যটক কয়েদিদের রানি, নবতরঙ্গের বিশেষ তদন্তকারী সদস্যদের রানি, নীতিপ্রণেতাবিহীন পর্যটনবিষয়ক রানি, জাতীয় রেইল সম্পদের সপ্তাবিহীনতার রানি, হরতালপূর্ণ বিশ্বশান্তির রানি ইত্যাদি… হঠাৎ সে থামে, মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করতে থাকে।
পুরো পোশাকের পাপেট
দেবদূত : রানি! রানি! রানি!… [চিৎকার কান্নায় রূপান্তরিত হয়] রানি… রানি… রানি… [পর্দা পড়ে; কিন্তু দেবদূতের ফুঁপিয়ে কাঁদা শোনা যায়] রানি… রানি… রানি…
গ্রিনগো কিন্তু পুরোটা সময়ই দর্শকদের সামনেই ছিল—তার লেখা বন্ধ হয়নি। এবার যখন পর্দা পড়ে সে কিন্তু পর্দার এ পারেই থাকে—এখনও দর্শকরা দেখছে সে লিখে চলেছে। সবকিছু শান্ত হয়ে এলে সে সব গোছগাছ করে—কাগজ, টাইপরাইটার, তার পরিচিতি লেখা কাগজগুলো। মঞ্চ থেকে দর্শকদের দিক হয়ে সে চলে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করে। নামে, চলার পথেই প্রথম দর্শকসারির কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে থামে।
গ্রিনগো : পোর ফাবোর, দনদে কেদা এল কোররেও? তেনগো উনা হিসতোরিয়া মুই ইনতেরেসতানতে সব্রে এসতে পাইস ই দেবো মানদারলা ইনমেদিয়াতামেনতে আ মিস পেরিওদিকোস। [টের পায় দর্শক কিছু বুঝতে পারছে না। তাই সে ভারী বিদেশি অ্যাকসেন্টে বাংলায় বলে] ডাকঘরটা কোথায় বলতে পারেন? খুব চমকপ্রদ একটা স্টোরি আপনাদের দেশ নিয়ে… আমার দেশের পত্রিকায় ছাপা হওয়া দরকার এবং এক্ষুনি এটা পাঠানো প্রয়োজন [একটা উত্তর পেয়েছে এমনভাবে, হাত দিয়ে দেখিয়ে] এই দিকে? আচ্ছা ধন্যবাদ [চলতে শুরু করবে এই সময় সে হোঁচট খেলে হাত থেকে টাইপরাইটারটা পড়ে যায়] উফ্! [তুলে নেয়] আমার টাইপরাইটার—খুব প্রিয়। এক বুড়ো দম্পতির কাছ থেকে একদম না-মূল্যে কিনেছিলাম, টাকাই নিতে চাচ্ছিল না জানেন, ফেলে দিচ্ছিল। টাইপরাইটারটাও বুড়ো; কিন্তু খাসা মাল—বুঝতে হবে, উনিশশ বাইশ সালের রেমিংটন, রেমিংটন টুয়েন্টি টু… [হেঁটে এক্সিট দিয়ে বের হয়ে যায়। অন্ধকার।]