রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১) স্বতন্ত্র এক নাম। তিনি উপন্যাসে যেমন স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন, তেমনি ছোটগল্পেও। তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা সাকুল্যে ৪৯টি। এরমধ্যে নয়নচারায় (১৯৪৫) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৮টি; দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৫) গল্পগ্রন্থে রয়েছে ৯টি। বাকি ৩২টি অগ্রন্থিত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সমাজমনস্ক লেখক। তাই তিনি ব্যক্তির আকাক্সক্ষা-অন্তর্দ্বন্দ্ব-অন্তক্ষরণের চিত্র আঁকেন সমাজের ভেতর থেকে। গল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রকৃতির বিরূপ চিত্রকে প্রাধান্য দেন। একইসঙ্গে সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ক্ষুধা, যৌনতাড়না, মৃত্যু, হিংসা, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, রহস্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জাত্যাভিমান, বর্ণভেদকেও গল্পের বিষয়বস্তু করে তোলেন। ফলে তাঁর গল্পে মানুষ ও নিসর্গ, প্রাণী ও প্রকৃতি কখনো কখনো লীন হয়ে যায়।
এসব অনুষঙ্গ এক জায়গায় এনে মালা গাঁথার ক্ষেত্রে তিনি দুটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রথমত, অভিজ্ঞতা; দ্বিতীয়ত মনোজগৎ। অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেন তিনি। এর কারণ হয়তো এই—মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরে তার কল্পনাও যায় না। মানুষের এই অভিজ্ঞতা আবার দুই রকমের। প্রথমত প্রত্যক্ষ, দ্বিতীয়ত পরোক্ষ। মানুষ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পুরোটা প্রকাশ করে না, কখনো কখনো প্রকাশ করতেও চায় না। বিপরীতে পরোক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের কল্পনার রঙ চড়িয়ে গল্প বলতে পছন্দ করে। তাই অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিশেল দিয়েই কথাশিল্পীরা গল্প-উপন্যাসের সৌধ নির্মাণ করেন। অভিজ্ঞতার বাইরে যে মানুষের কল্পনাও যায় না, তার প্রধান ও মোক্ষম উদাহরণ হলো তার দেবতা-ভগবান-ঈশ্বরের রূপ কল্পনা। মানুষ নিজের অবয়ব যেমন দেখে, তেমনি দেবতা-ভগবান-ঈশ্বরের আকারও কল্পনা করে। এ কারণে মানুষের মতোই দেবতা-ভগবান-ঈশ্বরেরও হাত-পা-মাথাসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে। এমনকি তারাও মানুষের মতোই কথা বলে। যে ধর্মীয় জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে, তাদের ঈশ্বর-ভগবানও সেই ভাষা ভিন্ন অন্যভাষায় কথা বলে না। অভিজ্ঞতা ও কল্পনা-সংক্রান্ত ওপরের সূত্রটির প্রয়োগ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে। যথাস্থানে সে প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করা হবে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র গল্পের দ্বিতীয় প্রধান অনুষঙ্গ—ব্যক্তির মনোজগৎ। তিনি ব্যক্তিমনের জটিল রহস্যের সন্ধানে কাজ করেছেন নিরন্তর ডুবুরির মতো। একইসঙ্গে মনোজগতের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির মনোজগতের রহস্যেও উদ্ঘান করতে না পেরেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছেন ব্যক্তির ওপর বহুকৌণিক আলোর প্রক্ষেপণ। ফলে রহস্যের পর্দা ভেদ করে তাঁর সামনে সত্য স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। তিনি অভিজ্ঞতা ও মনোজগতের সমন্বয় ঘটানোর জন্য প্রথমে নির্মাণ করেন জুতসই চরিত্র। চরিত্রের আচরণ, সংলাপ, স্বভাব, কর্ম ও কল্পনার ভেতর দিয়ে তিনি সময়-সমাজ-রাষ্ট্র-প্রকৃতি; সর্বোপরি মানুষের অন্তর্জগৎ-বহির্জগতের সন্ধান করেন। এই সন্ধানের পথে চরিত্রই হয়ে ওঠে প্রধান অবলম্বন। অবশ্যই গল্পে তিনি কাহিনিও বোনেন। সে কাহিনি চরিত্রকে পাশ কাটিয়ে পাঠককে কোথাও নিয়ে যায় না। বরং চরিত্রের আচরণ-কল্পনা-কর্ম ও প্রত্যয়ের অনুগামী হয়েই কাহিনির শুরু হয়, আর শেষ হয় চরিত্রকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ব্যবচ্ছেদের ভেতর দিয়েই। এই প্রসঙ্গে সমালোচক বীরেন্দ্র দত্তের উক্তি প্রণিধানযোগ্য।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র ছোটগল্পে যাবতীয় বাস্তব ও মনোলোকের অভিজ্ঞতা (experience) তার সৃষ্টির মূলধন (capital) আর চরিত্র হল সেই মূলধন খাটাবার উপায়, আশ্রয়। তাই চরিত্রই ওয়ালীউল্লাহ্-র ছোটগল্পের জীবনবেদ রচনার, প্রতিষ্ঠার শক্ত ভিত।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র গল্পের চরিত্ররা স্ব-স্ব সমাজ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে কল্পনাও করে না। এই কারণেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্প বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিষয়-কাহিনির ভেতর প্রবেশের আগে চরিত্রের দিকে সবিস্ময়ে তাকাতে হয়। সবিস্ময়ে এজন্য যে, চরিত্রগুলো প্রায়ই পাঠকের চেনা। প্রতিদিনই এসব চরিত্রের সঙ্গে কোথাও না কোথাও পাঠকের দেখা হয়। কথা হয়। এই চরিত্রগুলোর মধ্যে অতিমানবীয় গুণ যেমন নেই, তেমনি অতি দানবীয় বৈশিষ্ট্যও নেই। তবে, এসব বৈশিষ্ট্যের কোমল-মসৃণ মিশ্রণ ঘটেছে অধিকাংশ চরিত্রেই। এসব চরিত্রের মধ্যে যেমন অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার লুকিয়ে রয়েছে, তেমনি বিত্ত-ক্ষমতার দাপটে অতিভোগের লালসাও প্রকট হয়ে উঠেছে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জীবনের চারিদিককে কেবল সমস্যাসংকুল করেই মানবচরিত্রের বিচার করেন না, সুখস্বপ্ন-কল্পনার কুসুমাস্তীর্ণ অনুভূতিও আঁকেন কোথাও কোথাও। তাই তাঁর গল্প হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক-জটিল। এখানে নিষ্ঠুরতা-দয়ামায়া-হাহাকার একাকার হয়ে ওঠে। সামগ্রিক আলোচনা দেখা যায় তাঁর গল্পে মূলত তিনটি বিষয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে। এগুলো হলো:
ক. অস্তিত্বচেতনা ও বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা
খ. জীবনের নিরাভরণ প্রকাশ
গ. ধনীর কাছে দরিদ্রের, ক্ষমতাবানের কাছে নিরীহের পরাজয়
আলোচনার সুবিধার্থে ও পুনরুক্তি এড়িয়ে চলার স্বার্থে তিনটি বিষয় একসঙ্গে আলোচনার জন্য গ্রহণ করা হলো। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ জীবনকে দেখেছেন কদর্যের ভেতর। আবিষ্কার করেছেন মানবজাতির হিংস্রতার ভিন্ন রূপ। যে রূপ সাধারণত মুখোশের আড়ালেই থাকে। ফলে বাইরে থেকে তার সম্পর্কে জনমনে স্পষ্ট কোনো ধারণা থাকে না। সাধারণ মানুষ ক্ষমতাবানদের অভিনয় যতটা দেখে, হিংস্র রূপ ততটা ধরতে পারে না। জীবনের এই কুরুক্ষেত্রে অনাহারে-অর্ধাহারে-লাঞ্ছনায়-বঞ্চনায়ও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। সাধারণ মানুষ আত্মসম্মান-প্রতিপত্তির মোহে আচ্ছন্ন হয় না। তারা দুই মুঠো অন্নের জন্য যতটা পরিশ্রম করতে ও ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকে, আত্মসম্মান-প্রতিপত্তির কাক্সক্ষায় এর তিলার্ধও ভাবে না। কারণ ক্ষুধার তাড়না তাদের এতটাই উদগ্র করে তোলে যে, সেই আগুন নেভানোর চিন্তাভিন্ন অন্য কিছু ভাবার ফুসরতটুকুও পায় না।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এই দারিদ্র্যপীড়িত-নিরন্ন-ভাগ্যবিড়ম্বিত-উদ্বাস্তু মানুষের ছবি এঁকেছেন ‘নয়নচারা’, ‘মৃত্যু-যাত্রা’, ‘খুনী’, ‘একটি তুলসীগাছের আত্মকাহিনি’ গল্পে। এরমধ্যে নয়নচারা গল্পগ্রন্থের ‘নয়নচারা’য় দুর্ভিক্ষপীড়িত একদল মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণার রূঢ়চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গল্পে নয়নচারা নামে একটি গ্রামের কথা বলা হয়েছে। যে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ময়ুরাক্ষী নদী। সেই গ্রামে দুর্ভিক্ষ নেমেছে। ১৯৪৩ সালের সেই দুর্ভিক্ষে চিত্রই ‘নয়নচারা’র উপজীব্য। জীবন বাঁচাতে মানুষের ঢল নেমেছে কলকাতা শহরের দিকে। এই হা-ভাতেদেরই একজন গল্পের প্রধান চরিত্র আমুও। কিন্তু আমু যে আশা নিয়ে নয়নচারা গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় হাজির হয়, তার সেই আশাভঙ্গ হতেও বেশি দেরি হয় না। সে দেখে শহর হিংসা, নিষ্ঠুরতা ও শত্রুতায় আকীর্ণ। আমু খাবারের সন্ধানে পথে পথে ঘুরতে থাকে। একপর্যায়ে ক্ষুধার তাড়নায় একটি বাড়ির দরজায় করাঘাত করে। তখন যে মেয়েটি বের হয়ে আমুকে একটু ভাত দেয়, তাকে দেখে সে চমকে ওঠে। ভাত নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায় আমু। আর প্রশ্ন করে—
‘নয়নচারা গাঁয়ে কী মায়ের বাড়ি?’
তার এই প্রশ্নের কোনো জবাব মেয়েটি দেয় না। বরং দরজা বন্ধ করে দেয়। গল্পের কাহিনি এটুকুই।
‘নয়নচারা’ গল্পের প্রধান চরিত্র আমু। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে ময়ুরাক্ষী নদীর তীরবর্তী গ্রাম নয়নচারা থেকে দলে-দলে লোক কলকাতায় উপস্থিত হয়। তারা শুনেছে শহরে বিত্তশালীরা থাকে। তারা অনেক দান করে। এছাড়া লঙ্গরখানা আছে। তাই গ্রামের এসব নিরন্ন মানুষ খাদ্যের সন্ধানে কলকাতায় পাড়ি জমায়। কিন্তু যে ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা শুনে নয়নচারা গ্রাম থেকে নিরন্ন আমু শহরে আসে, তার কিছুই পায় না আমু। শহরে এসে দাঁড়াতেই সে ভাবনার অতলে হারিয়ে যায়। সে কলকাতার প্রশস্ত রাস্তা আর নয়নচারা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী ময়ুরাক্ষীকে এক করে দেখে। গল্পের শুরুই হয়েছে এমন তুলনার মাধ্যমে।
ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ুরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে। কিন্তু মনের চরে যখন ঘুমের বন্যা আসে, তখন মনে হয় ওটা সত্যি ময়ুরাক্ষী—রাতের নিস্তব্ধতায় তার কালো স্রোত কল কল করে, দূরে আঁধারে ঢাকা তীররেখা নজরে পড়ে একটু-একটু, মধ্যজলে ভাসন্ত জেলে ডিঙ্গিগুলোর বিন্দু-বিন্দু লালচে আলো ঘন আঁধারেও সর্বংসহা আশার মতো মৃদু মৃদু জ্বলে।
ময়ুরাক্ষী নদীর কুপিজ্বলা নৌকার দৃশ্যের সঙ্গে শহরের সড়কবাতির আলোআঁধারিকে এক করে দেখে আমু। সড়কবাতির সঙ্গে নৌকার কুপি কিংবা নদীর সঙ্গে প্রশস্ত সড়কের সাদৃশ্য দেখা আমুর সচেতন মনের প্রকাশ নয়। দিগ্বিদিকশূন্য দিশাহারা নিরন্ন মানুষের মনের ভ্রান্তি-চোখে দেখার ভুলই এই চিত্র। কেননা আমু বিত্তশালী নয়, কেননা আমি উচ্চশিক্ষিত নয়, এমনকি শহুরেও নয়। তাই সড়কবাতিযুক্ত রাতের সড়ককে কুপিজ্বলা নৌকাসমেত ময়ুরাক্ষী নদী হিসেবে কল্পনা করার বিলাসীমন আমুর থাকার কথা নয়। নিরন্ন মানুষেরা শহরের লঙ্গরখানা রাতে দুমুঠো খেতে পায়। খাওয়া শেষে তারা ঘুমিয়েও পড়ে। কিন্তু আমুর চোখে ঘুম আসে না। তার মন পড়ে থাকে ময়ুরাক্ষী নদীতে। নয়নচারা গ্রামে।
আমু দেখে শহরের রাতের চেয়ে দিনের দৃশ্য আরও নিষ্ঠুর-আরও নির্দয়। এখানে ‘রোদদগ্ধ দিন খরখর করে।’
দিনের বেলায় আমুর মনে হয়, গ্রামের মানুষ যেমন মানবিক, সহৃদয়, তেমনি শহরের কুকুরগুলোও আন্তরিক-দয়ালু। গ্রামের মানুষ ও শহরের কুকুরের চোখে বৈরিতা নেই। আর উল্টোচিত্রও ভাবে সে, গ্রামের কুকুরের চোখে যেমন হিংস্রতা, বৈরিতা, তেমনি শহরের মানুষের চোখও হিংস্রতা-নিষ্ঠুরতায় আকীর্ণ।
‘শহরের কুকুরের চোখে বৈরিতা নেই। এখানে মানুষের চোখে, এবং দেশের কুকুরের চোখে বৈরিতা।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দেখিয়েছেন, দুর্ভিক্ষের করালগ্রামে মানুষ দিশাহারা। মানুষের হাতে টাকা নেই, তাই মনে দয়ামায়াও নেই। যে মানুষ নিজেই খেতে পায় না, সে আরেক নিরন্নের দিকে সহানুভূতির হাত বাড়াতে পারে না।
এখানে একটি বিষয় বিস্ময়জাগানিয়া। যে মানুষ ক্ষুধা জ্বালা মেটাতে এসে খাদ্যের সন্ধানই পায় না, সে শহরের যানবাহনের বিকট শব্দ ও ল্যাম্পপোস্টযুক্ত সড়কের সঙ্গে গ্রামের ময়ুরাক্ষী নদীর কুপিজ¦লা নৌকার দৃশ্য কল্পনা করে আমু। আবার গ্রামের নির্দয়-নিষ্ঠুর-হিংস্র মানুষের সমান্তরালে গ্রামের স্নেহশীল-দয়ামায়ায় পরিপূর্ণ মানুষের কল্পনাও করে। মানুষ-প্রকৃতির তুলনামূলক বিচারে আমুর মনোজগতে ঢেউ ওঠে, স্রোত জাগে। ঢেউ ভাঙে, স্রোত থামে। সে দেখে খাবারের দোকানে সামনে দাঁড়াতে পারে না। তাকে তাড়িয়ে দেয় হিংস্র মানুষ। শেষপর্যন্ত সে ঘুরতে ঘুরতে একটি বাড়ির দরজায় দাঁড়ায়। সেই বাড়ি থেকে একটি মেয়ে বের হয়ে আসে। তাকে খাবার দেয়। খাবারের সন্ধানে গ্রাম থেকে আসা নিরন্ন মানুষের এই সংগ্রাম, অচেনা শহরের পথে পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলার ভেতর দিয়ে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। এই গল্পে আমু চরিত্রের নেপথ্যে দুর্ভিক্ষপীড়িত নয়নচারা জনপদের মানুষের পাশাপাশি শহর কলকাতায় যূথবদ্ধ নিরন্ন মানুষের নীরব আর্তনাদের কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সমালোচকের ভাষায়,
‘‘‘নয়নচারা’ গল্পের আমু যুদ্ধ-সমকালীন সময়ের মহামন্বন্তরের অন্যতম শিকার। তার মূলে যে নিয়ন্ত্রক শক্তি, তা মূলত সেই মন্বন্ত্বরই।”
জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শতভাগ বাস্তবানুগ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। জীবনকে দূরবীন দিয়ে দেখেননি। এমনকি যাপিত জীবনের যে চিত্র তিনি দেখেছেন, ভদ্রজনোচিত সমাজে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে কোনো পোশাক পরাননি। জীবনকে যেখানে যেভাবেই দেখেছেন, সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। মিথ্যে সভ্যরূপের ছাপ আরোপ করেননি। ফলে কোনো কোনো তাঁর গল্পকে মনে হয়েছে অমার্জিত-অসংস্কৃত। তা যত কদর্য, যত ভয়ানক ও হিংস্রই হোক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নরম তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন, পরিষ্কারভাবে। গল্পের ড্রয়িং কিংবা রঙের প্রলেপের ক্ষেত্রে কোথাও অপ্রয়োজনে একটি রেখাও টানেননি। দেননি অতিরঞ্জনের তুলির টানও। ‘জাহাজী’, ‘পরাজয়’, ‘রক্ত’, ‘খণ্ডচাঁদের বক্রতায়’ প্রভৃতি গল্পে জীবনের এমন কঠিন-অলঙ্কারশূন্য চিত্রে দেখা মেলে।
এর আগে ‘জাহাজী’ গল্পেও দেখা গেছে ছাত্তার জাহাজ ছেড়ে বন্দরে নামার সময় করিম সারেঙ্গের কাছ থেকে বিদায় নেয় না। এমনকি যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফিরে পিতৃপ্রতীম করিম সারেঙ্গের দিকে তাকায় না। ছাত্তার ও রাজ্জাক—দুজনেই স্বার্থপর।
‘জাহাজী’ গল্পে স্বজনহীন, বন্ধুহীন, সন্তানহীন বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। এই গল্পে দেখানো জাহাজের তরুণ লস্কর-খালাসিরা বৃদ্ধ করিম সারেংয়ের আপনজন। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তরুণ লস্কর ছাত্তার তার সুখে-দুঃখে করিম সারেংয়ের কাছে আসে। বিপদে-আপদে আশ^াস দেয়। তার ওপর কোনো অন্যায় আচরণ হলে, তার প্রতিকার করতে না পারুক; অন্তত প্রতিবাদ জানায়। তরুণ ছাত্তারকে পুত্রস্নেহে দেখে বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ। একসময় করিম সারেঙ্গ জানতে পারে ছাত্তারের বাড়িতে মা-বাবা আছে। তখন করিম সারেঙ্গ ভাবে, তার মতো ছাত্তার কেন বাবা-মা ছেড়ে সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবে। করিম সারেঙ্গ আত্মসমালোচনায় দগ্ধ হয়। নামাজ পড়ে।
আগেই বলেছি, করিম সারেঙ্গ নিঃসঙ্গ। তিন কূলে তার আপন বলতে কেউ নেই। জাহাজে আসা অসহায়-নিরীহ লস্কররাই তার সন্তানের মতো। তাদের দুঃখে সেও দুঃখী হয়। এর মধ্যে লস্কর ছাত্তারের অসহায়ত্ত দেখে তাকে পুত্ররূপে স্নেহের আসনে বসায়। কিন্তু করিম সারেঙ্গ নিঃঙ্গ হলে কী হবে, ছাত্তারের তো পরিবার-পরিজন আছে। সে কেন নিজের বাবা-মাকে ভুলে করিম সারেঙ্গকে পিতৃজ্ঞান করে তার সঙ্গেই বছরের পর বছর সমুদ্রে ভেসে ভেসে কাটাবে? পরন্তু ছাত্তারের স্বজন আছে, করিম সারেঙ্গেও তেমন কেউ নেই, এই নিয়ে তার মনে ক্ষীণ ঈর্ষা-স্নেহ একইসঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। তবে, ঈর্ষাকে পরাজিত করে স্নেহার্দ্র পিতৃহৃদয়ের জয় হয়। বন্দরের কাছাকাছি যখন জাহাজ, তখন তীর দেখে করিম সারেঙ্গের মন খারাপ হয়। সে তীর দেখতে চায় না। কারণ তীর এলেই ছাত্তারের মতো যাদের স্বজন আছে, তারা জাহাজ ছেড়ে নেমে যাবে। করিম সারেঙ্গ আবারও নিঃসঙ্গ জীবনের বোঝা বয়ে সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ভেসে বেড়াবে। এমনই নিয়তি তার। এই নিয়ে স্রষ্টার কাছে বহুবার নিজের আকুতির কথা জানিয়েছে সে, জীবনের হিসাবনিকাশও করেছে। নামাজ পড়ে। নামাজে বসে স্রষ্টার সঙ্গে মনে মনে হিসাব কষে।
করিম সারেঙ্গের ভেতরটা যেন ফাঁপা, শূন্য, প্রচণ্ড ব্যর্থতায় রিক্ত। এবার সে অন্তরে আবার সে-প্রশ্নটি অবুঝ গোঁয়ার ছেলের মতো গুমরে গুমরে উঠতে লাগল। তুমি কী দিলে আমাকে, আর আমি কী দিলাম তোমাকে। স্বীকার করি, কিছু অর্থ মিলেছে। কিন্তু সে থেকে বঞ্চিত হলেই কি অধর্মের বন্যা ছুটবে, আর মিললেই কি ধর্মের বজ্র ঘোষণা হবে? দীর্ঘ জীবন-তো অতিক্রম করে এলাম, জীবনের এ-পিঠ ও-পিঠ উলটে-পালটে দেখলাম, তবু যৌবনে কল্পনায় যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে স্বপ্নের বাস্তব রূপান্তর দেখলাম না। কিন্তু, তোমার রাহমানিয়তের সীমা নেই, তুমি-ই বলেছ। তবে অর্থ প্রাপ্তিতে তৃপ্ত মন তোমার সে-কল্পনাতীত অনন্ত করুণাসাগরে ভেসে তৃপ্তি পাবে কি?
তবু, মনে শান্তি পায় না। করিম সারেঙ্গ বুঝতে পারে—
নিঃসঙ্গ জীবনে ছাত্তারকে যতই পুত্রস্নেহে অধিকার করে রাখুক, তাকে ভুলে গেলে চলবে না, এই জাহাজী জীবন ওই স্বজনত্যাগীর নয়। ছাত্তার কখনোই তার মতো জীবনের পোড়খাওয়া নয়। সে সর্বত্যাগী কিংবা সর্বংসহাও হতে পারবে না। তাই ছাত্তারকে ডেকে বলে, ‘—অ’ডা গেয়া, খতা হুনি যা। তারপর অদ্ভুত মমতায় বললে, তুই বারিৎ যা গই, আর ন আইছ্।’
এরপর ছাত্তার যেদিন জাহাজ থেকে নেমে যায়, বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ চেয়ে চেয়ে দেখে। ছাত্তারের চলে যাওয়ায় একদিকে খুশি হয়, অন্যদিকে তার পিতৃহৃদয় হাহাকার করে ওঠে। বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ রেলিং ধরে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়ে ছাত্তারের প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কষ্ট বাড়ে। মনে মনে আশা করে—
অন্তত যাওয়ার আগে ছাত্তার একবার করিম সারেঙ্গের দিকে তাকাবে। কিন্তু ছাত্তারের মন তখন বাড়ির জন্য উতলা। ছাত্তারের ওপর চিফ অফিসারের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকারের আশ্বাস দিয়ে যে বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ বলেছিল, ‘যা, আঁই দেইক্যুম’
আজ বাড়ি যাওয়ার আনন্দে তার দিকে একবারও ফিরে তাকানোর কথা মনে এলো না তার। অব্যক্ত বেদনায় বৃদ্ধ সারেঙ্গের মন গুমরে ওঠে—‘ও তাকাল না।’
এই আক্ষেপ-লক্ষ্যহীন অনুযোগ-হাহাকার চিরকালীন পিতৃহৃদয়ের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মানবচরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যের সন্ধান করেছেন। মানবহৃদয় মন্থন করে উন্মোচন করেছেন সেই রহস্যের।
‘জাহাজী’ গল্পে স্বজনহীন-স্ত্রী-সন্তানশূন্য বৃদ্ধ সারেঙ্গের নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত মানসপ্রকৃতি ও হৃদয়ের ঔদার্যের ভেতর দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ্ দেখিয়েছেন, নিজের সুখের জন্য অন্যকে তার বাঞ্ছিত সুখ থেকে বঞ্চিত করতে নেয়। কারও জন্য স্নেহমমতা থাকলে তাকে স্নেহের বাঁধনে বাঁধা যায়, কিন্তু বন্দি করা চলে না। তাকে মুক্ত করে দিতে হয়। শ্রদ্ধা-ভক্তি মানুষের অন্তরের বিষয়, জোর করে তা আদায় করা যায় না। মানুষ মাত্রই স্বার্থপর, স্বার্থের জন্যই কাছে আসে, সাহায্য চায়। স্বার্থ ফুরালে উপকারীর দিকে কৃতজ্ঞচিত্তে তাকানোর প্রয়োজনটুকুও মনে করে না। এদিক থেকে দেখলে লস্কর ছাত্তারকে অকৃতজ্ঞই মনে হবে। অথচ এই ছাত্তারকে নির্যাতনকরী চিফ অফিসারের উদ্দেশেই করিম সারেঙ্গ বলেছিলেন, ‘হেতেরা কি মানুষ!’
কিন্তু করিম সারেঙ্গের দিকে নিজের বিদায়বেলায় একবারও পেছন ফিরে না তাকানোর কারণে এই প্রশ্নটিই যেন ছাত্তারের দিকেই ঘুরে গেলো—‘তাহলে কে মানুষ’?
‘মৃত্যু-যাত্রা’রও পটভূমি দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতায় একদল মানুষের মৃত্যুমুখী যাত্রাকে এই গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় এই গল্পে একক কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। যদি কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে, তাহলে সেটি দুর্ভিক্ষ, তারও বেশি মৃত্যু। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ একদল মানুষকে মৃত্যুর দিকে টেনে যায়। নিরন্ন মানুষের খাবারের সন্ধানে যাত্রার মতো বেদনাদীর্ণ ঘটনাপুঞ্জের ভেতর দিয়ে গল্পের শুরু—শেষও। আর মাঝখানে দোলে যূথবদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি। অন্নের সন্ধানে বের হয়েছে তারা। কিন্তু কোথায় অন্ন? কখনো খবর মেলে কোনো দূর গ্রামে খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। সবাই সেই গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আবার উদ্যোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় হাজুর মা বুড়ির মৃত্যু। তাকে দাফন না করে দলটি তো কোথাও যেতে পারে না। দলের ভেতর ফের গুঞ্জন শুরু হয়। দেখে গ্রাম থেকে একদল যুবক বের হয়ে আসছে। তাদের কাঁধে খাটিয়া, কাফনের কাপড়। মাটি কাটার কোদাল নেই। তবু তারা লাশ নিয়ে গ্রামের দিকে যায়। দাফন শেষে ঘাটের দল ঘাটেই ফিরে আসে। এবার খাদ্যের সন্ধানে যাওয়ার পথে বাধা কাটলো। তাই নতুন করে ভাবতে থাকে দলটি। দলের সদস্য তিনু বলে, ‘—কুতি যাবা আজ? সন্দি নাগে-নাগে, গঞ্জে পৌঁছুতি অনেক রাত হয়ি যাবে। তার চাইতি চল মোরা গাঁয়ে যাই। এক চৌধুরী সায়েবের কথা শোনলাম, পায়ে ধরি পড়লি পরে দুটি খাতি দেবেন না কি?’১২ তিনুর কথার পর দলটি আবার কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে। একজন এগিয়ে যায় বুড়ো হাজুর বাপের কাছে। তাকে উঠতে বলে। সাড়া না পেয়ে সমস্বরে সবাই ডাকে—‘অ হাজুর বাপ!’ কিন্তু হাজুর বাপের সাড়া নেই। ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হাজুর মা বুড়ির মৃত্যুর পর লাশ দাফন না করে খাদ্যের সন্ধানে দলটি বের হতে চায়নি। কিন্তু হাজুর বুড়ো বাপের মৃত্যুর পর লাশ রেখেই গ্রামের দিকে যাত্রা করে দলটি। তাদের বিশ্বাস যারা গ্রাম থেকে এসে বুড়ির লাশ দাফন করেছে, তারাই এসে বুড়োর লাশেরও ব্যবস্থা করবে। গল্প এখানেই শেষ। খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়া একদল নিরন্ন মানুষের আশা-নিরাশার দোলায় দোদুল্যমানতার ভেতর দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই করতে করতে এগিয়ে চলে। তাদের একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে বেঁচে থাকার উদগ্র বাসনা। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সেই ভয়াল দৃশ্যের ছবি আঁকতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গল্পের শেষে বলছেন, ‘তারপর সন্ধ্যা হল, হাওয়া থামল, ক্রমে ক্রমে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল। এবং প্রান্তরের ধারে বৃহৎ বৃক্ষের তলে তার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বুড়োর মৃতদেহ বসে রইল অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মতো।’১৩ দুর্ভিক্ষে নিরন্ন মানুষের ক্ষুধার তাড়না এতটাই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল যে, পাশে লাশ রেখে কান্নার পরিবর্তে খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়াই শ্রেয় মনে হতো তাদের। কারণ দিনে পর দিন খাদ্যের অভাবে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। ক্ষুধায় কঙ্কালসার দেহ ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। হাজুর বাপের লাশের মতো আরও আরও মৃতদেহ যেন বসে থাকে ‘অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মতো’। জীবন-মৃত্যুর চিরায়ত রূপ নিয়ে লেখকের এই দার্শনিক উক্তি দুর্ভিক্ষকবলিত জনপদ ও সময়কে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্তবাক্য হয়ে ওঠে। জীবনের কঠিন-রুঢ়-নিষ্ঠুর রূপ এভাবেই এঁকেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তুলির আঁচড়ে।
‘নয়নচারা’ ও ‘মৃত্যু-যাত্রা’ উভয় গল্পের অন্তর্গত সুর এক। বিষয়ও এক। কিন্তু চরিত্র চিত্রায়ণ ও স্থান-পরিবেশ ভিন্ন। ‘নয়নচারা’র নিরন্ন আমুর ওপর লেখকের সমস্ত মনোযোগ নিবিষ্ট ছিল। কিন্তু ‘মৃত্যু-যাত্রা’য় একক কোনো চরিত্রের ওপর লেখকের দৃষ্টি নিবদ্ধ নেই। বরং সব চরিত্রই অভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে ‘মন্বন্তর-মৃত্যু’কেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রূপান্তরিত করেছে। তাই কাহিনিতেও এসেছে ভিন্নতা। ‘নয়নচারা’য় আমুর লড়াই টিকে থাকার, মৃত্যু-যাত্রা’র চরিত্রগুলোর লড়াই সম্মিলিতভাবে টিকে থাকার। এই প্রসঙ্গে জিনাত ইমতিয়াজ আলী’র উক্তি প্রণিধানযোগ্য:
‘নয়নচারা’ ও ‘মৃত্যু-যাত্রা’ দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত হলেও গল্পদ্বয়ের চরিত্রায়ণ কৌশল, লেখকের প্রেক্ষণবিন্দুগত অবস্থান অভিন্ন নয়; পৃথক-সূত্রাশ্রয়ী, চরিত্রসমূহের বাস্তব অবস্থান সংম্বলিত। ‘মৃত্যু যাত্রা’য় কোনো একক চরিত্র গল্পকারের আকর্ষণ- কেন্দ্র নয়। এ গল্পে তিনি ব্যক্তিক চেতনার বাইরে গিয়ে সমগ্র গ্রামবাসীর অখণ্ড চৈতন্যরূপকে ধরতে চেয়েছেন। ক্যানভাসের এই ব্যাপ্তির কারণে একজন নিপুণ স্কেচ-শিল্পীর মতোই তিনি তুলির সংক্ষিপ্ত রেখাভাসে ‘মৃত্যু-যাত্রা’র চরিত্রসমূহ মূর্ত ও রূপান্তরিত করেছেন। তিনু, করিম, কলমি, মতি, আসগর—কারোর প্রতিই গল্পকারের বিশেষ অভিনিবেশ নেই, অথচ তাঁর চরিত্রচিত্রায়ণের মৌলিকত্বে প্রতিটি চরিত্রই বাস্তব, নিজস্ব চারিত্রে বিশিষ্ট ও পরিচিত।
জিনাত ইমতিয়াজ আলীর মূল্যায়ন যথার্থ। ‘নয়নচারা’য় আমু চরিত্র আঁকার ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যেমন গ্রামীণ প্রকৃতি-প্রাণের সঙ্গে শহরের প্রকৃতি প্রাণের তুলনা-প্রতিতুলনার প্রয়াস চালিয়েছেন, ‘মৃত্যু-যাত্রা’য় সেদিকে যাননি। তবে, শেষোক্ত গল্পের প্রতিটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করেছেন। সেই বর্ণনায় লেখকের দয়ামায়া যেমন নেয়, তেমনি বিরাগ-বিদ্বেষও না। লেখক কেবল এক নির্মোহ-নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ‘মৃত্যু-যাত্রা’ দেখেছেন, আর প্রয়োজন রঙের মিশিলে উপযুক্ত তুলির আঁচড়ে তার চিত্রায়ণ করেছেন।
মানবসন্তানের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার এক ঘনায়মান অনুভূতি ও জীবনযাত্রায় অস্তিত্ববাদী চেতনার গল্প ‘খুনী’। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজ্জাক। সে চর আলেকজান্দ্রায় ফইন্নি নামে এক যুবককে খুন করে উত্তরবঙ্গের কোনো এক মহকুমা শহরে উপস্থিত হয়। সেখানে দর্জি আবেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা। প্রায়ান্ধকারে বসে থাকা রাজ্জাককে দেখে বারবার প্রশ্ন করে আবেদ মিয়া। কিন্তু কোনো জবাব পায় না। শেষে লণ্ঠন নিয়ে রাজ্জাকের কাছে দাঁড়ায়। আর তখনই সে উঠে দাঁড়ায়। এরপর অস্পষ্ট কণ্ঠে দ্রুত বললো,
আঁর নাম রাজ্জাক। আঁই আলেকজন্ডর চরের সোনাভাঙা গেরামের মৌলবীর বাড়ির ফোলা। চৈৎ মাসে একদিন দুফর ওক্তে ফজুমিঞা’গর বাড়ির ফইন্যার মাথা ফাডাইলাম, ফাডাই জানের ডরে দেশ ছাড়ি ফলাইলাম। তারপর তুন—এই বলে হঠাৎ সে কী একটা নিদারুণ ভয়ে থেমে গেল, তার চোখ দুর্জয় ভয় ও শংকায় কেমন হয়ে উঠল; তারপর তার দেহ দুর্বল হয়ে উঠে এক সময়ে সে ঝুপ্ করে পড়ে গেল দর্জির পায়ের কাছে।
রাজ্জাকের গৃহত্যাগ-পালিয়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্য বুঝতে দেরি হয় না বৃদ্ধ আবেদের। আবেদ বিস্ময়ের সঙ্গে আরও লক্ষ করে—রাজ্জাক তার পা দুখানা জড়িয়ে আছে। কেবল জড়িয়েই নয়, জিহ্বা দিয়ে চাটছেও। শক্তিমানের কাছে দুর্বল-আশ্রয়হীনেরা চিরকাল এভাবেই নিজেকে সমর্পণ করে। আবেদ পা সরাতে গেলেও পারে না। বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর ইচ্ছায় রাজ্জাক আশ্রয়ের আশায় দর্জি আবেদের পাদুখানা আরও শক্ত করে ধরে। ইতোমধ্যে লোকজন সমবেত হয়। তার পরিচয় জানতে চায়। দর্জি আবেদের মনে পড়ে ১২ বছর আগে তার ছেলে মোমেন ঘর ছেড়েছিল। আর ফিরে আসেনি। রাজ্জাকের আশ্রয়ের কথা ভেবে নিজের হারানোর ছেলে ফিরে আসার কথাই জানায় আবেদ। বলে, তার ছেলে মোমেন ফিরে এসেছে। রাজ্জাককে বাড়িয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। কিন্তু রাজ্জাক যে খুন করে এসেছে, সে তথ্য গোপন রাখে। বাইরে লোক জানলো মোমেন ফিরে এসেছে, আর আবেদের পরিবার জানে, লোকটা মোমেন নয়, রাজ্জাক।
এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, আশ্রয় পাওয়ার আশায় রাজ্জাক কেবল আবেদের পা জড়িয়েই ধরে না; তাকে জীবনরক্ষাকারীর আসনে বসিয়ে তার পা-ও চাটে। বাধ্য হয়ে নয়, আদিষ্ট হয়ে নয়, মনের ভেতর জেগে থাকা ভয়ে, বাঁচার দুর্মর বাসনায়। দ্বিতীয়ত, আবেদ মিয়া জেনেশুনেও একজন খুনিকে নিজের ছেলে হিসেবে পরিচয় করে দেয় সবার কাছে। এমনকি তাকে ছেলে পরিচয়ে নিজের বাড়িতে নিয়েও আশ্রয় দেয়। হারানো ছেলে স্মৃতি তাকে এতটাই নরম করে তোলে যে বিপদাপন্ন রাজ্জাককে সেই আসনে বসিয়ে পিতৃহৃদয়ে যন্ত্রণা ভুল চায় আবেদ। এখানে ‘জাহাজী’ গল্পের বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গের সঙ্গে দর্জি আবেদের মৌলিক মিল রয়েছে। করিম সারেঙ্গ তরুণ লস্কর ছাত্তারকে পুত্রস্নেহেই আগলে রাখতো। কিন্তু ছাত্তার যখন বাড়ি যেতে চেয়েছে, তখন বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ তাকে আটকে রাখতে চায়নি। ছাত্তারের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ‘খুনী’ গল্পেও রাজ্জাক যখন আশ্রয় চেয়েছে, আবেদের পিতৃহৃদয় সাড়া না দিয়ে পারেনি। তাকে গ্রহণ করেছে। রাজ্জাককে মোমেন পরিচয়ে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার মধ্যেই ঘটনা সীমাবদ্ধ নেই।
হঠাৎ করেই একদিন নিরুদ্দেশ মোমেন বাড়ি এসে হাজির। রাজ্জাককে দেখে করে, ‘তুমি বুঝি মোমেন সেজেছ?’ এমন প্রশ্ন রাজ্জাকের ভালো ভালো লাগেনি। কারণ রাজ্জাক নিজে থেকে মোমিন সাজেনি। আবেদ তাকে মোমিন পরিচয়ে আশ্রয় দিয়েছে। তাই সে জবাব দেয় না। এরপর রাজ্জাকের নাম জিজ্ঞাসা করে মোমেন। এবার রাজ্জাক অতীতে ফিরে গেলো। সে জানান দিতে চায়, তাকে আশ্রিত ভেবে দুর্বল ভাবার সুযোগ নেই। সে যেনতেন মানুষ নয়। একজন খুনি। মোমেন-রাজ্জাকের ওই সময়ের কথোপকথন এভাবে এসেছে—
রাজ্জাক। বলে থামতেই কী একটি উত্তেজনায় তার ঠোঁট কেঁপে উঠল, কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে অদ্ভুত কঠিন গলায় বললে, আমার নাম আবদুর রাজ্জাক। আলেকজন্ডর চরের সোনাভাঙা গেরামের ফজুমিঞাদের বাড়ির ফইন্যারে আমি খুন করছি—গত চৈৎ মাসে।
মোমেন কয়েক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল, গিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে হইচই বাধিয়ে তুলল চিৎকার করে। কিন্তু তার আগে-ই রাজ্জাক বাইরে চলে এল—এবং এল চিরদিনের জন্যে।
মোমেন জানতো না রাজ্জাককে আবেদই আশ্রয় দিয়েছে। আবার আবেদ বুঝতে পারেনি ১২ বছর পর ফিরে এসে মোমিন এমন আচরণ করবে। মোমেনের নিজের বাড়ি। সেখানে রাজ্জাক আশ্রিত—তাও মোমেন পরিচয়ে। তদুপরি আত্মস্বীকৃতি খুনি। সঙ্গত কারণে মোমিন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আর সেই উত্তেজিত কণ্ঠের জবাব দিতে মোমেনের মনেও ভয় ধরিয়ে দিতে চেয়েছে রাজ্জাক। তাই ফইন্যাকে খুন করার কথা সদম্ভে জানান দেয়। নিজের খুনি পরিচয় জানান দেওয়ার পর দর্জি আবেদের বাড়িতে থাকার সব ধরনের অধিকার সে হারিয়েছে। তাই চিরদিনের মতো বের হয়ে পড়তে হলো। যাওয়ার সময় আশ্রয়দাতা আবেদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কিংবা বিদায় নেওয়ার সৌজন্যটুকুও দেখায় না রাজ্জাক। এর আগে ‘জাহাজী’ গল্পেও দেখা গেছে ছাত্তার জাহাজ ছেড়ে বন্দরে নামার সময় করিম সারেঙ্গের কাছ থেকে বিদায় নেয় না। এমনকি যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফিরে পিতৃপ্রতীম করিম সারেঙ্গের দিকে তাকায় না। ছাত্তার ও রাজ্জাক—দুজনেই স্বার্থপর। উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর অভ্যাস তাদের চরিত্রে নেই। এই আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য জীবনসংগ্রামে টিকে থাকা ভাগ্যবিড়ম্বিত অধিকাংশ মানুষের মজ্জাগত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নির্মোহ দৃষ্টিতে এই বৈশিষ্ট্য উভয় চরিত্রের ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
এমন অলীক ভাবনাজাত কাহিনির পরতে পরতে ওয়ালীউল্লাহ্ মানুষের অবচেতন মনের গভীর কুটুরিও মন্থন করেছেন। সেই মন্থনে কেবল মনোবিকলের খবর বের হয়ে এসেছে এমন নয়, ব্যক্তিজীবনে দৃশ্যমান পরিবর্তনও এসেছে।
১৯৪৩ সালের মহামন্বন্তরের পর ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ঘটনা-দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের ফলে হাজার হাজার মানুষকে দেশ পরিবর্তন করতে হয়েছে। দেশত্যাগী হতে হয়েছে। দেশান্তরী হয়ে কেউ কেউ নতুন ভূখণ্ডে মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছে। কারও কারও ভাগ্যে জুটে উদ্বাস্তুর জীবন। দেশভাগের এই যন্ত্রণা কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কেও নিঃসন্দেহে ব্যথিত করেছে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা ও মানসিক অস্থিরতার ফল ‘একটি তুলসীগাছের আত্মকাহিনি’। দেশভাগের ঘটনা ওয়ালীউল্লাহ্ মনোজগতে যেমন অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, তেমনি তার পারিপার্শ্বিকতার ওপরও রেখোপাত করেছে। সমাজের সচেতন মানুষ হিসেবে সমাজ ও নিজের কাছে তাঁকে এই মর্মন্তুদ ঘটনার নিজস্ব ও সামাজিক ব্যাখ্যা দাঁড়া করাতে হয়েছে। কেননা, মহামন্বন্তরের পরপরই দেশভাগের ঘটনা রাতারাতি যুগসন্ধির মতো সমাজে বিরাট পরিবর্তন সাধন করেছে, তেমনি মানুষের মনের ওপর বিপুল প্রভাবও বিস্তার করেছে। কারণ—
যে-কোনো যুগসন্ধির প্রতিক্রিয়া ঘটে দুদিকে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের ভিতর। তাই সংশয় ও বেদনার যুগের ফসল ছোটগল্প একাধারে ব্যক্তিমূলক ও সমাজমূলক। এই ব্যক্তিমূলক গল্পগুলির মর্মোদ্ধারই সব চাইতে কঠিন কাজ। এই সব গল্পের মধ্যে কখনো আত্মতান্ত্রিক বিষণ্নতা, কখনো অবচেতনার ছায়া সঞ্চরণ। পাঠককে অনেকখানি গভীরে প্রবেশ করেই ব্যক্তি-প্রধান গল্পের গুহানিহিত তাৎপর্য এবং সামাজিক অবস্থার সঙ্গে স্পষ্ট সংযোগটিকে নির্ণয় করতে হবে।
উল্লিখিত আলোচনার আলোকে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘একটি তুলসীগাছের আত্মকাহিনি’ যুগসন্ধির চিহ্নধারণকারী গল্প। কেনা গল্পটি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পটভূমিতে রচিত। এই গল্পে দেখানো হয়েছে একদল উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয়ের সন্ধানে সংগ্রামের চিত্র। দেশভাগের সময়ে কলকাতায় যেমন দলে দলে উদ্বাস্তু বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে) যায়, তেমনি কলকাতা তেকেও দলে দলে উদ্বাস্তু বাংলাদেশে আসে। তাদেরই একদল ভাগ্যবান উদ্বাস্তু এসেই একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে। বাড়ি দখলকারীরা হলো—মতিন, আমজাদ, কাদের, বদরুদ্দিন, ইউনুস, হাবিবুল্লাহ, মোদাব্বের, মকসুদ ও এনায়েত। অবশ্যই তারা সবাই সরকারি চাকরিজীবী। বাড়ি দখলের খবর পেয়ে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করতে পুলিশ আসে। নোটিশ দেয় বাড়ি ছাড়তে। কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ—বাড়ি ছাড়বে না। পুলিশও সেই যাত্রায় ফিরে যায়। উদ্বাস্তুরা ঘরদোর পরিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তখনই একজনের চোখে পড়ে একটি তুলসীগাছ। তখন সবাই মিলে ঠিক করে ‘হিন্দুয়ানি’ সংস্কৃতির চিহ্ন তুলসীগাছটা উপড়ে ফেলবে। কিন্তু উপড়ে ফেলে না। এতে হুঙ্কার দেয় হুজুগে মোদাব্বের—‘বলছি না, উপড়ে ফেল!’১৮ কিন্তু কেউ তার কথা মান্য করে না। ফলে তুলসীগাছটি রয়ে যায়। বরং কদিন পর দেখা গেলো সবার অজান্তেই দলটির কেউ একজন তুলসীগাছটির নিয়মিত পরিচর্যা করে চলেছে। আবারও পুলিশ আসে। তবে এবার পুলিশ আর খালি হাতে ফিরে যায় না। উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করে বাড়িটি দখলমুক্ত করে। যারা এতদিন বাড়িটি দখলে রেখেছিল, তুলসীগাছটি উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল, গল্পের শেষে দেখা গেলো, তাদেরই উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু তুলসীগাছটি যথাস্থানেই রয়ে গেছে। এই গল্পের অবকাঠামোয় দেশভাগের করুণ চিত্র বর্ণনা করা হলেও, অন্তরের কথা ভিন্ন। দেশভাগের জন্য যারা হিন্দুদের দূষতো, সেই মুসলমানদেরই একদল উদ্বাস্তু এসে সেই হিন্দুদের বাড়িই সাময়িক দখল করে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নেয়ছল। হিন্দুদেরই পূজার তুলসীগাছ তাদেরই সর্দিকাশিতে পথ্যের কাজে লাগবে ভেবে আর উপড়ে ফেলেনি। উল্টো প্রতিদিন পানি দিয়ে গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখে। যতদিন এই বাড়িতে ছিল ততদিন পরিচর্যার কমতি রাখেনি। উভয় সম্প্রদায়ের দোষারোপের রাজনীতির আড়ালে একটি তুলসীগাছ সগর্বে অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা নিয়ে গল্পের শেষেও দাঁড়িয়ে থাকে। তবে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদের পর তুলসীগাছটি শুকিয়ে যেতে থাকে। গল্পের শেষ এভাবে-
সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয়নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়েনি। কেন পড়েনি সে-কথা তুলসীগাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা।
দেশভাগের ফলে কেবল যে সাধারণ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, তা নয়। সরকারি চাকরিজীবীদেরও বাসস্থানের সংকট দেখা দিয়েছিল। যে যেখানে যেভাবে বাড়ি-ঘর পেয়েছে, সে সেখানে সেভাবে দখল করেছে। দখলের চেষ্টা করেছে। মানুষ টিকে থাকার জন্য খাদ্যবস্ত্রের পর বাসস্থানের জন্য ছুটেছে। সেই ছুটে চলায় বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। একটি বাড়িতে একদা যারা ছিল, তারা দেশভাগের ফলে দেশান্তরী হয়েছে। সেই শূন্যবাড়িতে আরেকদল দখল নিয়েছে। আইনের মারপ্যাঁচে তাদেরও সেই বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু ওই বাড়িটি রয়ে গেছে। তার সঙ্গে কাল ও ঘটনার নির্মম সাক্ষী হয়ে রয়েছে একটি তুলসীগাছও। আর সেই তুলসীগাছটি সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে উড়িয়ে দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের একপক্ষের কাছ থেকে পূজা আর অন্যপক্ষের কাছ থেকে ভক্তি-সেবা আদায় করে নিয়েছে। গাছটি একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পূজনীয় হয়েও অন্যধর্মের পরিচর্যা পেয়েছে—এখানে জীবের প্রতি প্রেমে ধর্মীয় সংকীর্ণতা বাধা হয়ে দাঁড়ালেও টিকে থাকতে পারেনি।
‘পরাজয়’ গল্পের প্রধান চরিত্র কুলসুম, তার স্বামী ছমির এবং ছমিরের দুই বন্ধু মজনু ও কালুকে নিয়ে গল্পের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। ছমিরের মৃত্যুর পর মজনু ও কালুর দৃষ্টি পড়ে কুলসুমের ওপর। স্বামীর লাশের পাশে নৌকায় বসা কুলসুমের ভরা যৌবন, তাকে পাওয়ার জন্য কাক্সক্ষাপোষণ করে মজনু ও কালু দুজনেই। বিষয়টি বুঝতে পারে কুলসুম নিজেও। কিন্তু সে প্রতিবাদ করতে পারে না। দুজন যুবকের বাহুশক্তির কাছে কুলসুমের শারীরিক শক্তি তুচ্ছ। কিন্তু মজনু-কালু দুজনই যখন কুলসুমের দিকে কামনার চোখে তাকায়, সে সদ্য বিধবা নারী ‘হঠাৎ ভয়চকিত কণ্ঠে আচমকা কেঁদে উঠে ঝুঁকে সরে এসে মজনুর পা ছুঁতে লাগল ঘন-ঘন।’২০ পেশীশক্তির বিপরীতে আচমকটা কান্না ও মজনুর পা ছুঁয়ে মিনতির কৌশল কুলসুমের ভেতর ভিন্নমাত্রার মানসিক শক্তির দেখা মেলে। আর এই শক্তির কাছে মজনু-কালু দুজনেই প্রচেষ্টাহীন পরাজয় বরণ করে। এরপর ‘মজনু নেবে গেলে নিচে, কালুও উঠে পড়ল। দুজনার মুখই কাঠের মতো নিস্পন্দ।’২১ এখন প্রশ্ন হলো—এখানে কার পরাজয় ঘটলো? দুজন যুবকের মধ্যে কুলসুমের প্রতি প্রেম-কাম জাগতেই পারে। সেক্ষেত্রে দুজনের দিকে না হোক একজনের দিকে কুলসুম ঝুঁকতে পারতো। কিন্তু সদ্য স্বামী মারা গেছে। স্বামীর শোকে যে মুহ্যমান, তার কাছে প্রেমের প্রস্তাব দুর্বিষহই ঠেকে। আর এখানে তো কুলসুমের দিকে মজনু-কালু দুজনের কারও প্রেমের দৃষ্টি নেই। তারা কামনা-লালসার চোখেই তাকিয়েছে। ফলে কুলসুমের পক্ষে সে আহ্বান গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আবার নৌকায় সে একা। বাহুবলে দুই যুবকের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি তার নেই। কিন্তু তখনো সে মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেনি। কুলসুম জানে—মানসিক্ত শক্তির কাছে পেশীশক্তির পরাজয় অসম্ভব নয়। বুদ্ধিগত কৌশল অনেক সময় বাহুবলকেও পরাজিত করতে পারে। কুলসুমও সেই বৌদ্ধিক কৌশল-মানসিক শক্তি প্রয়োগ করলো মজনুর ওপর। আর তাতে রিপুতাড়িত মজনু উদগ্র বাসনা থেমে গেলো। মজনু থেমে গেলে সঙ্গী কামনার চোখে তাকানোর সাহস আর কালুরও থাকে না। এখানে একজন সদ্যবিধবা নারীর মানসিক শক্তি-বৌদ্ধিক কৌশলের কাছে কামকাতর দুই যুবকের পরাজয় ঘটে।
‘রক্ত’ গল্পের নায়ক আবদুল। ছিল জাহাজের খালাসি। যক্ষা তাকে কাবু করে ফেলেছে। ফলে চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হয়েছে। তাই তার জীবন বিপর্যস্ত। দীর্ঘ সাতবছরের চাকরি হারিয়ে আবদুল উদ্ভ্রান্ত। বিষণ্ন-হতাশাগ্রস্ত আবদুল একদিন রাস্তার পাশে একটি পানদোকানের টুলে বসে থাকে। এই সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে আরেক সহায়-সম্বলহীন আক্কাসের। একদিকে চাকরিচ্যুতি, অন্যদিকে নতুন করে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, আবদুলকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবু হঠাৎ যখন তারই মতো আরেক নিঃস্ব আক্কাসের সঙ্গে দেখা হয়, তখনই অসহায়ত্ব, বেকারত্ব, দুঃখ-যন্ত্রণাদীর্ণ উভয়ের জীবনের মিল তারা দুজনেই আবিষ্কার করে। শেষে ক্লান্ত-অবসন্ন আবদুলকে শহরতলীর বস্তিতে নিজের বাসায় নিয়ে যায় আক্কাস। বাসায় আক্কাসের স্ত্রী আছে। তাই বাসার ভেতরে জায়গা হয় না আবদুলের। দড়ির খাটিয়ে বাসার বাইরে এনে আবদুলকে বিশ্রাম নিতে দেয় আক্কাস। এরপর দুই খালাসির জীবনের ব্যর্থতা-হাহাকার-অর্থকষ্ট নিয়ে ইতস্ততবিক্ষিপ্ত আলোচনা চলে। একসময় আবদুলের কাশি ওঠে। সেই কাশির সঙ্গে গলগল করে বের হয় রক্ত। অসুস্থ আবদুলকে এবার আক্কাস ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। এরপর আক্কাস ও তার স্ত্রী; দুজনই আবদুলের শুশ্রƒষায় নিজেদের নিয়োগ করে। আক্কাস দম্পতির পরিচর্যায় আবদুল তার নিঃসঙ্গ-স্বজনহীন জীবনের পাতা মনে খাতায় মেলে ধরে। দেখে সেখানে কিছু নেই। আক্কাসের স্ত্রী আছে, কিন্তু তার কেউ নেই। সে নিঃস্ব-স্বজনহীন। এই গল্পের আবদুল চরিত্রের অসহায়ত্ব-অসুস্থতা, আবার আক্কাসের প্রতি তার মমতার দিক দেখতে দেখতে ‘জাহাজী’ গল্পের বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গের কথাও মনে পড়বে। করিম সারেঙ্গ দীর্ঘজীবনের অধিকারী, কিন্তু নিঃসঙ্গ, স্বজনহীন। তবে সুস্থ। বৃদ্ধ বয়সেও জাহাজে চড়ে সমুদ্র থেকে সমুদ্রে তার অভিযাত্রা চলে। বিপরীতে আবদুল অল্পবয়সেই রক্ষায় আক্রান্ত হয়ে বেকারত্বকে বরণ করতে হয়েছে। উভয় গল্পে দুই জাহাজীর পেশাগত মিলের পাশাপাশি স্বজন-পারিবারিক-পারিপাশির্^কগত মিলও স্পষ্ট। অমিল শুধু একটি জায়গায়—করিম সারেঙ্গ বৃদ্ধ হয়েও সুস্থ-কর্মঠ, আবদুলের অল্পবয়সে স্থাস্থ্যক্ষয়—তাই চাকরিচ্যুতও সে। এর বাইরে আরেকটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে, সেটি পদমর্যাদার। ‘জাহাজী’ গল্পের বৃদ্ধ হলেও সুস্থ-কর্মঠ; কারণ সে সারেঙ্গ, তাকে লস্কও বা খালাসিদের মতো কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না। কিন্তু আবদুল খালাসি। তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। পরিশ্রম করতে করতেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখানে শ্রেণীবৈষম্যেও বিষয়টি করুণ অভিঘাত সৃষ্টি করে।
‘মতিনউদ্দিনের প্রেম’ গল্পটি মনোবিকলনের ফলজাত ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত। মতিনউদ্দিনের চরিত্রে দুটি বৈশিষ্ট্য একইসঙ্গে বর্তমান। একটি হচ্ছে তার বিনয়ী-নিরীহ-মিতভাষী রূপ। যার প্রমাণ সে কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী ও আড্ডায় বন্ধুদের কাছে দেয়। তার দ্বিতীয় রূপ হলো, ঘরে সে স্ত্রীর বদরাগী পুরুষ। তার এই নিত্য স্বভাবে হঠাৎই একদিন পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের নেপথ্যে কাজ করে তার স্বপ্ন। একরাতে সে স্বপ্ন দেখে—পুকুর পাশে বিরাট হাট বসেছে। ক্রেতা-বিক্রেতার সমাবেশে আকীর্ণ স্থানটি। মতিনউদ্দিন হঠাৎই এক নারীকণ্ঠের আর্তনাদ শোনে। সেই নারী তাকে উদ্ধারের জন্য মতিনউদ্দিনের সাহায্য চায়। মতিনউদ্দিনতাকে উদ্ধার করতে যায় কিন্তু পারে না। ঘুম ভাঙলেও তার ঘোর কাটে না। দিনে দিনে সে ওই নারীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বাসায় ফিরে আগের মতো আর তর্জনগর্জন করে না। প্রায় চুপচাপ থাকে। তার এই হঠাৎ পরিবর্তনে স্ত্রী খালেদা অবাক হয়। এবার সে সচেতন হয়ে ওঠে। এদিকে খালেদা বুঝতে পারে না কী ঘটছে। মতিনউদ্দিনভাবে—কোনো এক স্বপ্নপ্রাপ্ত অচেনা নারীর প্রেমে পড়েছে সে। আর নারীর প্রেম যদি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তাহলে তার স্ত্রীর কী হবে? স্ত্রীর ভবিষ্যৎচিন্তায় মতিনউদ্দিন দিশাহারা হয়ে পড়ে। একসময় তার সেই মোহ কেটে যায়। সে স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী হয়। দীর্ঘদিনের নিদ্রাহীনতার অবসান ঘটে। সে বিছানায় যায়।
শত্রুবিজয়ী সেনাপতির মতো আত্মসচেতনভাবে কিছুক্ষণ নড়েচড়ে সে যখন ঘুমের আয়োজন করে, তখন তার পিঠটা খালেদার পিঠের সঙ্গে একটু লেগে থাকে। গ্রীষ্মের দিনে সে সংস্পর্শ মধুর না হলেও মতিনউদ্দিন সরে না। খালেদার চোখে যখন নীরব অশ্রুর আবির্ভাব হয় তখন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে এমন রব তুলে মতিনউদ্দিন নাক ডাকাতে শুরু করেছে।
গল্পের সমাপ্তি এখানেই। কিন্তু পাঠক মনে রেশ বহদূরসঞ্চারী। স্বপ্নে কোনো এক নারীর সাহায্য চাওয়ার কথা মনে করে বিচলিত হয়ে পড়ে মতিনউদ্দিন। সে ভাবতে থাকে ওই নারীর জন্য মনের ভেতর যে অনুরাগ তৈরি হয়েছে, সেটি স্ত্রী খালেদার প্রতি তাকে উদাসীন করে দেবে। সে যদি সত্যিই এমন কোনো নারীর প্রেমে পড়ে, তাহলে খালেদার কী হবে? এমন অলীক ভাবনাজাত কাহিনির পরতে পরতে ওয়ালীউল্লাহ্ মানুষের অবচেতন মনের গভীর কুটুরিও মন্থন করেছেন। সেই মন্থনে কেবল মনোবিকলের খবর বের হয়ে এসেছে এমন নয়, ব্যক্তিজীবনে দৃশ্যমান পরিবর্তনও এসেছে। সরব মতিন উদ্দিনের হঠাৎ নীরবতায় বিচলিত খালেদার মনোজগৎ ও আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। যে কখনোই স্বামীর কথার পিঠে কথা বলে না, সেও ক্ষেপে ওঠে—‘মানুষটি যাচ্ছে কোথায়?’২৩এটি কেবল খালেদা নিছক প্রশ্ন নয়। কৈফিয়ত তলবও বটে। একইসঙ্গে হঠাৎ বদলে যাওয়া মতিনউদ্দিনের নীরবতার প্রতি তীব্র প্রতিবাদও।
বহুযুগের প্রবহমান চিত্র যেমন তাঁর সামাজচিত্রে দৃশ্যমান, তেমনি মন্বন্তর ও দেশভাগের মতো আকস্মিক-অনিবার্য কোনো কোনো ঘটনার অভিঘাতও সেখানে রেখাপাত করেছে। তাঁর গল্পের বিষয় আঞ্চলিক হয়েও জাতীয়, স্থানিক হয়ে আন্তর্জাতিক। আবার সমকালের হয়েও ভাবিকালের চিত্র।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মানুষকে দুই ভাগে দেখেছেন। প্রথম শ্রেণী বিত্তশালী—ধর্মে জোরে, ক্ষমতার জোরে—অর্থের জোরে, পেশীশক্তিতে তারা বলিয়ান। বৃহৎ সমাজ-রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উপাসনালয় থেকে শুরু করে পরিবারেও এই শ্রেণীর দৌরাত্ম্য-আদিপত্য বিরাজমান। দ্বিতীয় শ্রেণী দরিদ্র-নিরীহ—তারা যেমন ঐশীধর্মের ব্যাপারে উদাসীন, তেমনি ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ-অনীহ। সমাজে নিত্য এই দুই শ্রেণীর দ্বন্দ্ব চলে। প্রথম শ্রেণী সংখ্যায় অত্যল্প হলেও দরিদ্র-নিরীহ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ওপর তাদেরই কর্তৃত্ব চলে। সমাজ-রাষ্ট্রের শাসনদণ্ড যেমন তাদের হাতে থাকে, তেমনি ধর্মের বিধিবিধানও তাদের করায়ত্ত। ফলে দুনিয়ার ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের ভার যেমন তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করে, তেমনি পরকালের স্বর্গ-নরকের সনদ দেওয়ারও স্বঘোষিত আধিকারীক তারা। ফলে পাপ-পুণ্য-ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে সর্বকালে-সর্বদেশে-সর্ব সমাজে বিচারের কাঠগড়ায় কেবল দ্বিতীয় শ্রেণীকে দাঁড়াতে হয়। জবাবদিহিও করতে হয় তাদেরই। ‘দুই তীর’, ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতায়’ গল্পে এস বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
সমাজের নিম্নশ্রেণির সামাজিক ও অন্তর্গজগতের বিচিত্র স্বভাবের গল্প— ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতায়’। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শেখ জব্বার। সে দুটি ঘোড়ার গাড়ির মালিক। গল্পে এই মালিকের নাম দেওয়া হয়েছে মহাজন। সমাজের নিম্নশ্রেণীর ভেতর থেকে দুটি ঘোড়ার গাড়ির মহাজন হওয়ার সুবাধে অন্যদের চেয়ে তার অভ্যাস-রুচি-ইচ্ছা স্বতন্ত্র। তার জীবনাচারে যেমন বিকৃত, তেমনি সমাজও সেই বিকৃতির সমর্থক। শেখ জব্বার আগে তিন বিয়ে করেছে। এবার করবে চতুর্থ বিয়ে। গল্পের মূল উপজীব্যও তার চতুর্থ বিয়েকে কেন্দ্র করে। শেখ জব্বার তার চতুর্থ বিয়ে উপলক্ষে মহল্লার সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়ায়। সবাই আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। সেই আনন্দ-উল্লাসে যুক্ত হয় শেখ জব্বারের চতুর্থ বিয়ের বিকৃত আনন্দের রেশও। তার ঘরের বাইরে গ্রামাফোনে বাঈজি নাচের গান চলে। জব্বারের ঘোড়াকে ঘাস-ভুসি দেয় যে কাজের ছেলেটি, ঘাঘরা, ওড়না ও ঘুঙুর পরে নাচে অংশ নেয়। এসব চলে ঘরের বাইরে। এসবে যেমন বিকৃত আনন্দ আছে, উল্লাস আছে, তেমনি শেখ জব্বারের ঘরের ভেতরে চলছে তার নববিবাহিতা চতুর্থ স্ত্রীকে ঘিরে পূর্ববর্তী তিন স্ত্রীর ঈর্ষা। সেখানে চলছে নারীদেও শক্তিপরীক্ষা, হাতাহাতি শ্লীল-অশ্লীল শব্দবাণ। সেই লড়াইয়ের বলি হতে হয় চতুর্থ স্ত্রীকে।
নয়া বিবির অলঙ্কার ছিঁড়ে গেছে, কিছু খসে গেছে; তার দাঁতে দাঁত লেগেছে, এবং যে-চোখ অবিরত সেকেন্ডের কাঁটার মতো দ্রুত নড়ছিল কেবল, সে চোখ এখন নিমীলিত । তার দেহ হিংসার অনলে বিধ্বস্ত।
পয়লা বিবি কেঁদে উঠল:
এয়া খোদা, মেরি বেটিকী ক্যা হাল হুয়া?
চতুর্থ স্ত্রী সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে থাকলেও তাতে ঘরের বাইরের আনন্দে বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। বিত্তবান শেখ জব্বারের বিকৃত উল্লাসের কাছে তার চতুর্থ স্ত্রীর সুস্থতা-অসুস্থতা কিংবা একজন নিছক নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা গুরুত্বহীন, মূল্যশূন্য। বিত্তবানের রুচির বিকৃতির শিকার, অসহায় নারী; এমনকি পুরুষও। সমাজের এই কদর্যরূপ ‘খণ্ডচাঁদের বক্রতায়’ গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন ওয়ালীউল্লাহ্।
‘দুই তীর’ গল্পে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে মানুষের যে সামাজিক মর্যাদার হেরফের ঘটে, তারই চিত্র আঁকা হয়েছে। এই গল্পে প্রধান চরিত্র চারটি। এখানে দুটি জুটি রয়েছে। প্রথম জুটি আফসার উদ্দিন-হাসিনা, দ্বিতীয় জুটি আরশাদ আলী-মরিয়ম খানম। প্রথম জুটির আফসার উদ্দিনের শ্বশুর দ্বিতীয় জুটির আরশাদ আলী। আর হাসিনার মা মরিয়ম খানম। শ্বশুর আরশাদ আলী নিজেই অসুখী জীবনযাপন করে। স্ত্রী মরিয়ম খানম যেমন তাকে মানতো না, তেমনি কন্যা হাসিনাও না। তবে মা-মেয়েতে মিল তুলনাহীন। কন্যা হাসিন বিবাহযোগ্যা হলে আরশাদ আলী তাকে আফসার উদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে দেয়। আফসার উদ্দিন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন পরিশ্রমী-স্বাবলম্বী ছেলেকে জামাতা হিসেবে পছন্দ আরশাদ আলীর। তাই কারও অভিমতকে গুরুত্ব না দিয়ে একান্ত নিজের ইচ্ছায়ই হাসিনাকে আফসার উদ্দিনের সঙ্গে আরশাদ আলী বিয়ে দেয়। কিন্তু সে বিয়ে সুখের হয় না। আফসার-হাসিনা সংসারে ঝগড়া যেমন হয় না, তেমনি স্বামী-স্ত্রী মিলে কোনো সুখস্বপ্নের আলাপও জমে না। দুই জন দুই তীরের বাসিন্দা। শেষে একদিন মরিয়ম খানম এসে মেয়ে হাসিনাকে নিয়ে যায়। সেই চলে যাওয়ার দৃশ্য কেবল দেখে যায় আফসার উদ্দিন। স্ত্রীকে ফেরানোর কোনো চেষ্টাও করে না। এই গল্পে সামাজিক বাস্তবতার কঠিন-নগ্ন রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই গল্পে দ্বিধাহীনচিত্তে প্রকাশিত হয়েছে—পড়াশোনা-সংস্কৃতিচর্চা-বিদ্যার্জন করলেই কেউ বিত্তশালীর সমান সামাজিক পর্যাদার অধিকারী হতে পারে না। বিত্তশালীদের কাছে চিত্তবান কিংবা বিদ্বান কিংবা জ্ঞানী, কারও মূল্য নেই। বিত্তশালীরা বিত্তের মাপকাঠিতেই মানুষকে মূল্যায়ন করে। গল্পের হাসিনাও তাই করেছে।
হাসিনা যেমন স্বামী আফসারকে গুরুত্ব দেয় না, তেমনি তার মা মরিয়ম খানমও আরশাদ আলীকে মান্য করে না। আফসার-আরশাদ আলী সমাজের চোখে যতই মর্যাদা হোক, স্ব-স্ব স্ত্রীর কাছে তাকের মূল্য কানাকড়িও নেই। তাই মরিয়ম খানম যখন মেয়ে হাসিনাকে নিয়ে ট্রেনে পড়ে বসে, আর ট্রেনও চলতে শুরু করে, তখন আফসার উদ্দিনের আত্মোপলব্ধির জায়গায় এসে দাঁড়ায়। ট্রেনের দিকে তাকিয়েই দেখে নিজের ভেতরের অসহায়তাকে।
অবশেষে আফসারউদ্দিন সুস্থির হলে এবার শান্ত পরিচ্ছন্নতার মধ্যে সে সুস্পষ্টভাবে একটি মুখ দেখতে পায়। সে-মুখ হাসিনার নয়, মরিয়ম খানমেরও নয়। সে-মুখ আরশাদ আলী সাহেবের। তাঁর বয়স ক্লান্ত মুখে যেন গভীর পরাজয়ের ছায়া।
এই পরাজয় আসলে কেবল আরশাদ আলীর নয়, একইসঙ্গে আফসার উদ্দিনেরও। কেননা তারা উভয়েই নারীর মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। উভয়েই অসুখী জীবন যাপন করে গেছেন। আরশাদ আলী গোঁয়ার্তুমি দিয়ে সংসারে কর্তৃত্ব করেছেন, কিন্তু আফসার উদ্দিনের সেই সুযোগও ছিল না। ফলে বিত্তের সঙ্গে অর্থহীনের সম্পর্কও অর্থহীন। জোর করে বিয়ে হয়তো করা যায়, কিন্তু তাকে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয় না। দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জন্মানো। এজন্য উভয়ের রুচি-সংস্কৃতির সাম্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমতাও বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ওয়ালীউল্লাহ্ ‘দুই তীর’ গল্পের দুই জোড়া নর-নারীর সম্পর্কের মাঝখানের অলঙ্ঘনীয় ফাটল দেখিয়ে, সেই সত্যটাকেই দেখিয়ে দিয়েছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গল্পের পটভূমি তৈরি করেন, সঙ্গে সৃষ্টি করেন চরিত্র। এই দুইয়ের মিশ্রণে তৈরি হয় তাঁর গল্পের বহিরাঙ্গ ও অন্তরাঙ্গ। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ওয়ালীউল্লাহ্ যেমন নির্মোহ, তেমনি চরিত্রের আচরণ বর্ণনায় নিরাসক্ত-নিরপেক্ষ। কখনো চরিত্র ও ঘটনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উভয়ের মর্ম উপলব্ধে করেন; কখনো বা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন। ফলে ঘটনার অংশীজন হলেও কোনো ঘটনার প্রতি তাঁকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে দায়ী করা যায় না। যেমন ‘নয়নচারা’র আমুর সঙ্গে শহরবাসীর নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা এবং ‘মৃত্যু-যাত্রা’র বৃদ্ধ হাজুর বাপ ও বৃদ্ধা হাজুর মায়ের মৃত্যুর পর দলের বাকিদের খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়ার উদগ্র বাসনা স্বাভাবিক ও সহজাত কারণেই তৈরি হয়েছে। আবার ‘না কান্দে বুবু’র বুবু অছিমন চরিত্রের কান্না-হাসি-নিস্পৃহতাও স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে। এসব ঘটনা ও চরিত্রের মনভূমিকে প্রভাবিত করার মতো পক্ষপাত কিংবা প্রচেষ্টা কোনোটাই ওয়ালীউল্লাহ্র ভেতর নেই। এসব গল্পে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে অতি নাটকীয়তার প্রচেষ্টাও নেই। জীবন ও জীবনের পারিপার্শ্বকে তিনি বহুকৌণিক দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করেন, সঙ্গে দেন ব্যাখ্যাও। সমালোচক যথার্থই বলেছেন,
ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর পারিপার্শ্বিক জীবন ও জীবনার্থককে কেবল উপস্থাপন করেন না, তাকে ব্যাখ্যা করেন। জীবন-ব্যাখ্যার এই কেন্দ্রীয় আর্থ-সামাজিক কাঠামোলালিত ব্যক্তিচৈতন্যের লূতাততন্তুজাল উন্মোচনে লেখক বিশ্লেষণ, অন্তর্দর্শন ও অবলোকনের আশ্রয় নিয়েছেন।
আবার চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার পরও ওয়ালীউল্লাহ্ কোনো বিশেষ চরিত্রের জন্য পাঠকমনে সমবেদনা তৈরি করেন না। যেটুকু সমবেদনা পাঠকমনে তৈরি হয়, সেটুকু চরিত্রের স্বাভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণেই হয়। যেমন, ‘জাহাজী’ গল্পে বৃদ্ধ করিম সারেঙ্গ ও ‘খুনী’ গল্পে দর্জি আবেদ আলীর প্রতি পাঠকের সমীহ জাগে। কারণ তাদের একজন ছাত্তারকে আরেকজন রাজ্জাককে পিতৃস্নেহে আশ্রয় দিয়েছিল, ছায়া দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্তার ও রাজ্জাক দুজনেই করিম সারেঙ্গ ও দর্জি আবেদকে ছেড়ে চলে যায়। লেখককে একই রকম নিস্পৃহ থাকতে দেখা যায় ‘পরাজয়’ ও ‘রক্ত’ গল্পেও। এসব গল্পের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে লেখক মানুষের একাকিত্ব, নৈঃসঙ্গ্য, স্নেহ-মমতা, অস্তিত্বের সংকট, অকৃতজ্ঞতার ছবি এঁকেছেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচক মহীবুল আজিজের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে,
‘জাহাজী’, ‘পরাজয়’, ‘রক্ত’, ‘খুনী’ এসব গল্পে মানুষের অস্তিত্বের সংকট, শূন্যতা, মৌল মানব-প্রবৃত্তি ইত্যাদি বিষয়ের সৃজনশীল অন্বেষণ বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
শেষপর্যন্ত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র গল্প কেবল কতিপয় চরিত্রের নড়াচড়া-কান্না-হাসি-বিচ্ছেদ-মৃত্যুযাত্রাই নয়; আবার একের পর এক ঘটনার ঘনঘটাও নয়। এসবের সম্মিলিত রূপ তো বটেই, সঙ্গে আর্থ-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক সংকটের শিল্পিত চিত্রও। তাঁর গল্পে যে সমাজের চিত্র পাওয়া যায়, তা আরোপিত নয়। বহুযুগের প্রবহমান চিত্র যেমন তাঁর সামাজচিত্রে দৃশ্যমান, তেমনি মন্বন্তর ও দেশভাগের মতো আকস্মিক-অনিবার্য কোনো কোনো ঘটনার অভিঘাতও সেখানে রেখাপাত করেছে। তাঁর গল্পের বিষয় আঞ্চলিক হয়েও জাতীয়, স্থানিক হয়ে আন্তর্জাতিক। আবার সমকালের হয়েও ভাবিকালের চিত্র। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র ছোটগল্পের সার্থকতা এখানে যে, মহাভারতের কর্ণের মতো তার চরিত্ররা দারিদ্র্য-ক্ষুধা-মন্বন্তবরের কাছে পরাজিত হয়েও মানুষের সমবেদনা পায়- অভিমন্যুর মতো চক্রব্যূহে ঢুকে পড়ে বীরগতিপ্রাপ্ত হয়েও জীবন্ত হয়ে ওঠে।