রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২টি উপন্যাসের মধ্যে গোরা সর্ববৃহৎ এবং দ্বন্দমূলক জটিল উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ ৪৭ থেকে ৪৯ বছর বয়সে গোরা উপন্যাসটি লিখেছিলেন এবং প্রথমে ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে এবং উৎসর্গ করেন পুত্র রথীন্দ্রনাথকে।
প্রক্ষাপটঃ উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় সমাজ নানা টানাপড়েন ,নানা চিন্তা ও আদর্শের স্রোত এবং বিপরীত স্রোতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ভারতীয় জাতিসত্তা নির্মিত হচ্ছিল নানা দ্বান্দিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। জাতীয়তাবাদের নানা রূপ ধর্মের নানা ব্যাখ্যা এই সময় ফুটে উঠেছিল।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শক্তি ও দুর্বলতা দুটি প্রত্যক্ষ করেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের ব্যর্থতা তাকে আত্মনুসন্ধানী করে তুলেছিল।
সেই অন্বেষণ থেকেই দেশ, জাতি, জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে রবীন্দ্রনাথ গোরাকে সৃষ্টি করেন। গোরা উপন্যাসটিতে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, সমাজের সঙ্গে ধর্মের এবং ধর্মের সঙ্গে মানব সত্যের বিরোধ ও সমন্বয়ের ছোঁয়া রয়েছে।
গোরা কে?
গোরা অর্থাৎ গৌরমোহন আদতে একজন আইরিশ দম্পতির পুত্র, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সময় আইরিশ দম্পতি অসহায়ভাবে মারা গেলে অসহায় অনাথ গোরাকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ গৃহিণী আনন্দময়ী। নিজ সন্তানের মতোই মানুষ করেছেন। আনন্দময়ীর স্বামী কৃষ্ণদয়াল ও তা সমর্থন করেছিলেন। যদিও গোরা তার প্রথম জীবনের জন্মবৃত্তান্ত জানতেন না।
এইভাবে গোরা ও তার বাল্যবন্ধু বিনয় বড় হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে তাদের সাথে আলাপ হয় প্রতিবেশী ব্রাহ্ম পরেশ বাবু ও তার পরিবারের। গোরার বন্ধু বিনয় ব্রাহ্ম কন্যা সুচরিতার প্রতি দুর্বলতা ছিল। ঘটনাচক্রে সুচরিতাও গোরার প্রেমে পড়ে যায়। একদিক থেকে ত্রিকোণ প্রেমের গল্প থাকলেও গোরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ভরকেন্দ্র গোরার আত্ম উন্মোচন, বিশ্লেষণ এবং উত্তরণ।
গোরার হিন্দুত্ব:
গোরা হিন্দু প্রথা ও আচার আচরণ নিয়ে শ্রদ্ধাবান ছিলেন। তার ধারণা ছিল ঐতিহ্যগত আচার রীতিনীতি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে একাত্মবোধ সম্ভব। সুচরিতা যখন জানতে চেয়েছিল গোরা বিশেষ কোনও দলভুক্ত কিনা তখন সে নিঃসঙ্কোচে জানায় সে হিন্দু। যে হিন্দু কোনও দল নয়। হিন্দু একটা জাতি এই জাতি এত বৃহৎ যে এই জাতিত্ব কোনও সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যায় না। তার মতে হিন্দুধর্ম জগতে সব মানুষকে মানুষ বলে স্বীকার করেছে। হিন্দুধর্ম মূঢ়কে মানে, জ্ঞানীকে মানে।
গোরার লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যততে এক আদর্শ, সুখী ও সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ গড়ে তোলা। গোরা বিশ্বাস করত ভারতবর্ষের অগ্রগতি ও বিকাশের জন্য গ্রামের উন্নয়ন প্রয়োজন। গোরা ঘোষপাড়া নামের গ্রামে স্বদেশের আসল চেহারাটা দেখতে পায়। গ্রামের মানুষের দুর্দশা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং অন্যান্য ধরণের সমস্যা গোরাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। গোরা গ্রামজীবনের উন্নয়নের সঙ্গে ভারতবর্ষের অগ্রগতি বিষয়ে প্রয়াসী হয়।
তাই গোরা বিনয়কে বলেছিল, ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মূর্তিটা সবার কাছে তুলে ধরো, লোকে তাহলে পাগল হয়ে যাবে। প্রাণ দেবার জন্য ঠেলাঠেলি পড়ে যাবে।
গোরার উত্তরণ:
ঘটনাচক্রে গোরা নিজের আত্মপরিচয় জানতে পারে। সে ব্রাহ্মণ নয় বরং তার দেহে বইছে খ্রিস্টান রক্ত। নিজের জন্ম পরিচয় জানার পর আনন্দময়ীকে প্রণাম করে গোরা বলেন “মা তুমিই আমার মা।যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনি আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই- শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ”।
উপন্যাসের শেষে লছমিয়া হাতে জল খেয়ে গোরা নিজের সংস্কার মুক্তির কথা ঘোষণা করেন। গোরা আরও বলেন “আজ আমি এমন শুচি হয়ে উঠেছি যে চণ্ডালের ঘরে আমার আর অপবিত্রতার ভয় রইলো না” গোরা পরেশবাবুকে বলে “আমি আজ মুক্ত পরেশ বাবু… আমি একেবারে ছাড়া পেয়ে হঠাৎ সত্যের মধ্যে এসে পড়েছি। সমস্ত ভারতবর্ষের ভালোমন্দ, সুখ, দুঃখ, জ্ঞান অজ্ঞান একেবারেই আমার বুকের কাছে এসে পৌঁছচ্ছে”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরার মাধ্যমে উল্লেখ করেছিলেন “আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান কোনও সমাজের কোনও বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাত আমার জাত, সকলের অন্ন আমার অন্ন”।
গোরা তার জীবন শুরু করেছিলেন হিন্দুত্ব দিয়ে শেষ করলেন বিশ্ব মানবতায়।